যুগের ইমাম গাজ্জালি অধ্যক্ষ আল্লামা মুছলেহ উদ্দিন (রহ.)

মোহাম্মদ শাহজাহান. | মঙ্গলবার , ২১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ

জীবন নিয়ে গল্প লেখা অনেক সহজ, কিন্তু গল্পের মত করে জীবন সাজানো অনেক কঠিন। এই কঠিন বাস্তবতাকে ছান্দিক ও নান্দনিক ইনিংসে রূপদানকারীর সংখ্যা আমাদের সমাজে হাতে গোনা কজনইবা থাকেন? যাঁরা আবির্ভূত হন তাঁরা ক্ষণজন্মা নামে খ্যাতি লাভ করেন। তেমনি এক শালপ্রাংশু ব্যক্তিত্ব হলেন গাজ্জালিয়ে জমান, অধ্যক্ষ আল্লামা মুছলেহ উদ্দিন (রহ🙂। যাঁর পুরো কর্মজীবনের ব্যাপৃতি ছিল বহুরৈখিক অর্জন আর অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। শিক্ষা প্রশাসক, হাদিস বিশারদ, গবেষকসহ নানা অভিধা থাকলেও তিনি মূলত ইসলামী আইন শাস্ত্রের (ফেকাহ শাস্ত্র) প্রবাদপ্রতিম গুরু হিসেবে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার অন্তর্গত জোয়ারা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলভী আব্দুল আজিজ আর মাতার নাম রহিমুন্নেসা। হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা হতে ১৯৫৪ সনে দাখিল, গারাংগিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৬ সালে আলিম, দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৮ সালে মেধা তালিকায় ১৪ তম স্থান নিয়ে ফাজিল ও ৬ষ্ঠতম স্থান নিয়ে ১৯৬০ সালে কামিল পাস করেন। পরবর্তীতে আবার ১৯৬২ সালে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি. ১৯৬৪ সালে সিটি কলেজ থেকে এইচ এস সি এবং ১৯৬৬ ও ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যথাক্রমে ইতিহাস ও আরবিতে কৃতিত্বের সাথে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। জোয়ারা ইসলামিয়া, সীতাকুণ্ড আলিয়া ও পটিয়া হাইদগাঁও মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্ম জীবনের সূচনা হয়। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, তৎপরবর্তী থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম ছোবহানিয়া কামিল মাদ্রাসায় (মধ্যখানে ১৯৮৮ সনে এক বছরের জন্য ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ) তাঁর কর্মময় জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অধ্যক্ষ পদে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করলেও ছাত্রদের পাঠদানের বিষয়ে তিনি কখনো কার্পণ্য করেননি।

২০০৯ সালের পর কয়েক বছরের জন্য চট্টগ্রাম নেছারিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় হাদিসের দরস দেন। ১৯৭৮ / ৭৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নৈশকালীন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে কিছুদিন নিয়োজিত ছিলেন। ঐ কলেজ সরকারিকরণ করা হলে তাঁকে হয়তো মাদ্রাসা না হয় কলেজ কোনো একটি চাকরি বেছে নেয়ার জন্য বলা হয়। তিনি সানন্দে কলেজের চাকরি ত্যাগ করে মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। এমন কোনো বিষয় ছিল না, যে বিষয়ে তিনি গভীর জ্ঞান রাখতেন না। বৈষয়িক জ্ঞানের পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি ফতোয়াফারায়েজ, রাজনীতি, ধর্মনীতি, আন্তর্জাতিক ও সমসাময়িক ইসলামী শরীয়তের জটিল সমস্যাবলীর উত্তম সমাধানকারী এবং বাংলা, উর্দু, আরবি, ফার্সি, ইংরেজি সহ বহু ভাষায় তাঁর অসাধারণ ও ঈর্ষণীয় দখল ছিল বলে তিনি যুগের ইমাম গাজ্জালী উপাধিতে ভূষিত হন। দর্শন বিষয়ে ব্যুৎপত্তির জন্য ছাত্ররা তাঁকে সক্রেটিস হিসাবে আখ্যায়িত করতেন। এত উঁচু মাপের মহাজ্ঞানী হয়েও তিনি অতি সাধারণ, নির্লোভ ও নিরহংকার জীবনযাপন করতেন। বাহারুল উলুম, আমানতদার ও মোত্তাকি বুজুর্গ হিসাবে তিনি সর্বমহলে সমাদৃত ছিলেন। সমসাময়িককালে মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল তাঁর জীবনের পরমব্রত। লেখক হিসাবে স্বল্পপ্রজতার তকমা বহন করলেও তাঁর রচনা সম্ভার একেবারে সমৃদ্ধহীন ছিল তা বলা যাবে না। ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’, ‘ইসতিজার আলা ত্তাআত’ সহ বেশ কিছু কিতাব তিনি রচনা করেন। মাওলানা আব্দুল মান্নান (:জি:) কর্তৃক অনুবাদকৃত বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ কানযুল ঈমান এর নিরীক্ষণকার্য তিনি সমাধা করেন। (যা মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে কবুল হয়েছেন বলেই স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর ইন্তেকালের কয়েক দিন পূর্বে হসপিটালে রাত তিনটায় তিনি ছরকারে দো ‘আলম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খাঁন ফাযেলে বেরেলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি কে জাগ্রত অবস্থায় দেখে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় ও দাঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন এবং মহিউদ্দিন নামক এক ছাত্রকে বলছিলেনআমাকে দাঁড় করিয়ে দাও, আমার টুপি দাও, লাঠি দাও, আমার হুজুর এসেছেন, আ’লা হজরত এসেছেন)। আক্বিদার বিশুদ্ধতায় তিনি ছিলেন অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি ১৯৮২ সালে গঠিত ‘জামাতে আহলে সুন্নত বাংলাদেশ’র কেন্দ্রীয় পরিষদের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। যে পরিষদের সভাপতি ছিলেন ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ🙂। কর্ম বীরত্বের স্বাক্ষর হিসাবে তিনি ২০০৩ ও ২০০৫ সালে জাতীয় শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হিসাবে প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক লাভ করেন। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতির অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বতন্ত্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ঈদ জমাত কমিটি গঠন, কামালে ইশকে মোস্তফা কমপ্লেক্স, লালদীঘি জামে মসজিদ নির্মাণসহ অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দাবি আদায়ে তিনি পুরোধার ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদারেছীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন প্রায় এক যুগ পর্যন্ত। তাঁর স্বল্প বচন, পরিশীলিত রুচি, মননশীল মেধা আর জ্ঞানের বিশালতার কাছে সমকালীন যুগের সর্বস্তরের আলেমগণ ছিলেন শ্রদ্ধাস্পদ ও অবনত মস্তক। সত্যকথন আর নীতিনৈতিকতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ত্বরিকত চর্চার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতায় প্রভূত উন্নতির স্বাক্ষর স্বরূপ তিনি গারাঙ্গিয়া ও ফুরফুরা মুজাদ্দেদিয়া দরবারের খেলাফত লাভ করেন। মোস্তাজাবুদ দাওয়া হিসাবে তিনি সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন। ২০১২ সালের ২১ শে জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। চকবাজার ধোনিরপুল ফালাহ গাজী মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ছোবহানিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন সুরের তাল তালাশে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের সুপরিকল্পিত উদ্যোগের বাস্তবায়ন জরুরি