তথ্য ও সমপ্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয়, ২০৪১ সাল নাগাদ দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক রাষ্ট্র গঠনে বিতর্ক চর্চার বিকল্প নেই।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, আগে টেলিভিশনে বিতর্ক অনুষ্ঠান ছিল না। কারণ বিতর্কে অনেক সময় সরকারের সমালোচনা করা হয়। আমি তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু করি। কারণ সরকার সব সময় যুক্তিসঙ্গত বিতর্ককে স্বাগত জানায়। এর মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের সৃষ্টি হয়। তিনি গতকাল সকালে বাংলাদেশ টেলিভিশন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের প্রথম আন্তঃস্কুল ইংরেজি বিতর্ক প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন। চূড়ান্ত পর্বের বিতর্ক আয়োজনের মধ্য দিয়ে গতকাল সম্পন্ন হয় গত বেশ কয়েক মাস ধরে চলা এই টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। চূড়ান্ত পর্বে বিতর্কের বিষয় ছিলো ‘ডেভলপিং অন এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড বিজনেস এনভায়রনমেন্ট ইজ বেটার ড্রাইভার অব আওয়ার ইকোনমি দ্যান রিলায়িং অন রেমিটেন্স ইনকাম।’
মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ আরো বলেন, এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সরকার ২০০৮ সাল থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন শুরু করে যা এখন বাস্তবায়িত। তারপরও আমাদের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। তিনি শিক্ষার্থীদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে নিজেদের তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে বলেন, বিভিন্ন সূচকে ভারত এবং পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক রপ্তানিমুখী শিল্প প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি দেশের ৩০ লক্ষ নারী শ্রমিকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই শিল্পের পাশাপাশি বিকল্প শিল্পায়নের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, বিতর্ক মানুষকে যুক্তিবাদী হতে শেখায়। মুক্ত চিন্তা করতে শিক্ষা দেয়। যুক্তি এবং মুক্ত চিন্তা ছাড়া সভ্য সমাজ এগুতে পারে না বলেও এম এ মালেক মন্তব্য করেন। তিনি বিভিন্ন মনীষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সবার আগে নিজেকে চিনতে হবে, নিজেকে জানতে হবে। মন এবং বিবেকের সমন্বয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রকৃত মানুষই সমাজকে বাসযোগ্য করতে অনন্য ভূমিকা রাখে। তিনি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া বিতার্কিকদের ভবিষ্যতের সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রস্তুতি নেয়ারও আহ্বান জানান।
এম এ মালেক বলেন, প্লেটো তাঁর একাডেমিতে যেসব বক্তব্য দিয়েছিলেন তার কোনো প্রামাণিক দলিল নেই। তবে তার সংলাপগুলোতে দার্শনিক অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে যুক্তিবিদ্যার জনক বলা হয়। অ্যারিস্টটল প্রথম বিতর্কে যুক্তিবিদ্যার অবতারণা করেন। তিনিই প্রথম যুক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদান করেন এবং তা বিতর্কে প্রয়োগ করেন। দীর্ঘ দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যারিস্টটলের লজিক মানুষের চিন্তার জগতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন ‘নিজেকে জানো’, তেমনি মার্কাস সিসেরো পরামর্শ দিয়েছিলেন সমাজের সঙ্গে বিতর্ক করার আগে নিজের সঙ্গে বিতর্ক করো। ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে পারি।’ বিতর্কের মূল চেতনাই এই উক্তিতে ফুটে উঠেছে। শুধু ব্যক্তিজীবনে নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও যুক্তির অনুশীলন অপরিহার্য।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক আরো বলেন, মানুষ সাধারণত–বিবেক ও মন দিয়ে পরিচালিত হয়। মন দিয়ে তর্ক পরিচালিত হয় আর বিতর্ক বিবেকে পরিচালিত। মনে রাখতে হবে, তর্ক নয়, বিতর্কই আমাদের লক্ষ্য। তর্কের সঙ্গে আবেগ, একগুঁয়েমি ও অন্ধবিশ্বাস জড়িত। বিতর্ক আমাদের যুক্তিবাদী করে তোলে। বিতর্ক শিল্প হিসেবে নবীন হলেও শিক্ষিত ও সচেতন সমাজের কাছে এ শিল্প যথেষ্ট সমাদৃত। বিতর্কে উত্তেজনা থাকে। সে উত্তেজনা পরিশীলিত। আক্রমণ থাকে, সে আক্রমণ শিল্পিত। সার্বিক কর্মকাণ্ডে যেমন জ্ঞানের চর্চা হয়, তেমনি বিস্তার লাভ করে বুদ্ধির ডানা।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলাম প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া দুই দলকে অভিনন্দন জানান। তিনি তাদের নানাভাবে উৎসাহিত করে বলেন, কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। বিতর্কের মাধ্যমে আজ আপনারা যা শিখছেন তা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে কাজে লাগাতে হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় গড়ে উঠবে সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা। তিনি বিতার্কিকদের এই ধারা সামনের দিলগুলোতেও ধরে রাখার আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সুকান্ত ভট্টাচার্য্য বলেন, বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় এই স্বদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। দেশটি আমাদের সবার। আপনাদের সবাইকে একযোগে কাজ করে দেশটিকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রায় উদার চিন্তার মুক্ত মনের মানুষরাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার নূর আনোয়ার হোসেন রনজুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রাপন্তি চক্রবর্তী।
১ম আন্তঃস্কুল চূড়ান্ত পর্বের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় মডারেটর ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সুকান্ত ভট্টাচার্য্য। বিচারক ছিলেন প্রাক্তন বিতার্কিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামীম রেজা এবং চ্যানেল আই’র সিনিয়র রিপোর্টার মাশরুর শাকিল। প্রসঙ্গত, এবারে প্রতিযোগিতায় সারা দেশের ৬৪টি স্কুল অংশগ্রহণ করে।