যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশে ক্ষমতা উল্টাতে-পাল্টাতে পারে

‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের, গণতন্ত্রের, দেশের মানুষের শত্রু’ ।। ড. ইউনূসের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন

| মঙ্গলবার , ১১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতেপাল্টাতে পারে। দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের ছবক দেয়। আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচনকোঁদন করছেন, উঠবস করছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন। গতকাল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ অধিবেশনে আনা প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। খবর বাসস, বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।

শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে এ দেশের মানুষের অভিজ্ঞতা খুবই বিচিত্র। আমরা আইয়ুব আমল দেখেছি। ইয়াহিয়া আমল দেখেছি। জিয়ার আমল দেখেছি। জেনারেল এরশাদের আমল দেখেছি। খালেদা জিয়ার আমলও দেখেছি। আমেরিকায় তাঁর প্রথম সফরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে আন্ডার সেক্রেটারির সাথে সাক্ষাতকালে আমি বলেছিলাম, ‘আমি এখানে আসার আগে একটি মনুমেন্ট দেখে এসেছি। সেখানে লেখা আছে গভমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, সে দেশটি হচ্ছে গভমেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য জেনারেল। তিনি বলেন, ‘আমি সেই বৈঠকে বলেছিলাম, আমেরিকা আটলান্টিকের তীর পর্যন্ত তার গণতন্ত্রের চর্চা করে। আটলান্টক পাড়ি দিলেই কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে যায়?’ তিনি বলেন, ‘আমি তাদের এই প্রশ্নটিও করেছি, কেন আপনারা সামরিক স্বৈরশাসনকে সমর্থন করছেন ?’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশটি (যুক্তরাষ্ট্র) প্রায়ই গণতন্ত্রের কথা বলে এবং বিরোধী দলসহ কিছু লোক সেইসব সবক শুনে উৎফুল্ল বোধ করে। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তারা যে কোনো দেশের সরকারকে উৎখাত করতে পারে। বিশেষ করে, মুসলিম দেশগুলো কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের পর, পুরো বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে এবং এটাই বাস্তবতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যে তিনজন কংগ্রেসম্যানের ঘটনার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা আমাদের গণতন্ত্রের সবক দেন। সব ক্ষেত্রেই তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন। তাদের নিজ দেশের অবস্থা কী? কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যে তিনজন কংগ্রেস সদস্যকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কারণ তারা বন্দুক নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করে যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যেএই ধরণের বন্দুক সংরক্ষন বন্ধ করা উচিত। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর এই তিনজনকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু, তাদের একজন শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় বহিষ্কার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী রাশেদ আমেরিকায় আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি সেখানকার সব প্রেসিডেন্টের কাছে আবেদন করেছি। আইনগতভাবে, আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা কূটনীতির মাধ্যমে চেষ্টা করেছি। আমি রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি যে ‘আপনি এই দণ্ডিত খুনিকে আম্রয় দেবেন না। তাকে ফিরিয়ে দেন। কিন্তু, তারা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে না, বরং তাকে আশ্রয় দিয়ে খুনিদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।’

দৈনিক প্রথম আলোর কঠোর সমালোচনাও করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু।’ স্বাধীনতা দিবসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ও ফটো কার্ড নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা বক্তব্য ও কর্মসূচির মধ্যে প্রথমবারের মত বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী। তার অভিযোগ, কিছু বুদ্ধিজীবী, ও যারা ‘বুদ্ধি বেচে জীবিকা নির্বাহ করেন’ তারা, সামান্য কিছু পয়সার লোভে অগণতান্ত্রিক ধারা আনতে এদের (প্রথম আলো) তাবেদারি ও পদলেহন করে।

সংসদ নেতা বলেন, ‘(প্রথম আলো) দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে। এখন দেখা যায়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়ে তারা ওকালতি করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে তারা এমন একটা সরকার আনতে চাচ্ছে যার কোনো গণতান্ত্রিক অস্তিত্বই থাকবে না।’

প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনের সমালোচনা করে সংসদে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মাত্র একটা ছোট্ট শিশুর হাতে ১০টা টাকা দিয়ে, তাকে দিয়ে একটা মিথ্যা বলানো, শিশুর মুখ থেকে কিছু কথা বলানোকী কথা? ভাত মাংসের স্বাধীনতা চাই। একটা ৭ বছরের শিশু, তার হাতে ১০টা টাকা তুলে দেওয়া এবং তার কথা রেকর্ড করে তা প্রচার করা, স্বনামধন্য একটা পত্রিকা, খুবই পপুলার, নাম তার প্রথম আলো। কিন্তু কাজ করে অন্ধকারে।’ সংসদ নেতার বক্তব্যের সমর্থনে সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে ‘ঠিক, ঠিক’ উচ্চারণ করেন। কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘শেইম, শেইম’।প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এটা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলিএরা এদেশে কখনও স্থিতিশীলতা থাকতে দিতে চায় না।’

সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথম আলোর অবস্থান নিয়েও সমালোচনা উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে যখন ইমার্জেন্সি (জরুরি অবস্থা) হয়, তখন তারা উৎফুল্ল। দুটি পত্রিকা আদাজল খেয়ে নেমে গেল। তার সঙ্গে আসেন একজন সুদখোর (. মুহম্মদ ইউনূস)। বড়ই প্রিয় আমেরিকার।”

. ইউনূসের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা ব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক, একটা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সরকারের বেতন তুলতেন যে এমডি, তিনি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কোথা থেকে পেলেন যে আমেরিকার মত জায়গায় সামাজিক ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেন? দেশে বিদেশে এ অর্থ কোথা থেকে আসে, এটা জিজ্ঞেস করেছে কখনও তারা? এদের কাছ থেকে দুর্নীতির কথা শুনতে হয়! এদের কাছ থেকে মানবতার কথা শুনতে হয়! গরিবের রক্ত চোষা টাকা পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগ করে শত কোটি টাকার মালিক হয়ে আবার আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও পেয়ে যায় এবং এসব লোক এদেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে, মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।’

সংসদে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ যে বিধানের কারণে বন্ধ, বাংলাদেশের সংবিধানের সেই ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের দাবির বিপক্ষে নিজের অবস্থানও প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করেন।

তিনি বলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে অনেকেরই আপত্তি। যারা এই আপত্তির কথা তুলছেন, তাদের বোধহয় অভিজ্ঞতার অভাব আছে। এই ৭০ অনুচ্ছেদটাই কিন্তু আমাদের দেশে সরকারের একটা স্থায়ীত্বের সুযোগ এনে দিয়েছে। যার ফলে দেশটা উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ফ্লোর ক্রস করার কারণে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার টিকতে পারেনি। এর আগে ১৯৪৬ সালেও একই খেলা হয়েছিল। যার কারণে আমাদের পূর্ব বাংলাটা যেভাবে গঠন হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি। এটা ১৯৫৬ সালের নির্বাচনেও হয়েছিল। পরে মার্শাল ল এসে ক্ষমতা দখল করে।’

আওয়ামী লীগ সরকারে এসে কী করেছে, আর তার আগে কী ছিলতার কিছু হিসাব শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, দেশের মানুষও বিশ্বাস করে, ১৪ বছর একটানা ক্ষমতায় আছি বলেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছি। হ্যাঁ, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তারপরও আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করে দেশের মানুষের জন্য অতিরিক্ত দামে জিনিস কিনে এনেও আমরা খাদ্য নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি।

বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। যে বিরোধী দলকে বড় বিরোধী দল বলা হয়, তারা ২০০৮ সালে ২৯টি সিট পেয়েছিল। তারা যদি এত বড় বিরোধী দলই হয়ে থাকে, তাহলে ২৯টি সিট পেল কেন? তারা এতবড় দল কোত্থেকে হয়ে গেল? আর সাজাপ্রাপ্ত আসামি হচ্ছে সেই দলের চেয়ারপার্সন। হত্যাগুমখুনদুর্নীতিজঙ্গিবাদসবকিছুতেই যারা পারদর্শী ছিল। তাদের জন্য দেশের মানুষ আতঙ্কে থাকত। এখন তাদেরকে নিয়ে এত উৎফুল্লতা শুরু করছে। এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘কাল্পনিক’ নামে খাদ্যপণ্য বেচলে দুই বছরের সাজা
পরবর্তী নিবন্ধঈদের ছুটি বাড়ল আরো একদিন