অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ ও রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অতিমাত্রায় কড়াকড়ি বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল ‘লিবারেশন ডে’ উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে তার প্রশাসনের বিশ্বব্যাপী শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ঘোষণা’ হিসেবে অভিহিত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও ‘মহান’ করে তোলার অঙ্গীকারে দেশটির প্রশাসন বৈশ্বিক বাণিজ্য ঘাটতির অভিযোগ তুলে বিভিন্ন অংশীদার দেশের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে শুল্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, অংশীদার দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল বাণিজ্যনীতির সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকিয়ে আসছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লাভবান হয় তুলনামূলক সুবিধার ভিত্তিতে। শুল্ক আরোপ করে উদীয়মান শিল্পকে সাময়িক সুরক্ষা দেওয়া গেলেও এতে আমদানি ব্যয় বাড়ে, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, এবং ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশে এই ধরনের শুল্কনীতি বৈশ্বিক বাণিজ্য ভারসাম্যকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এ শুল্কনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল। তিনি সতর্ক করে বলেন, উচ্চ শুল্কের কারণে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, গড় মার্কিন পরিবার এই শুল্ক বৃদ্ধির কারণে বছরে প্রায় ৩,৮০০ ডলার অতিরিক্ত ব্যয়ে পড়তে পারে। ইয়েল বাজেট ল্যাবের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৪ সালে ঘোষিত নতুন শুল্কের কারণে এই অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কড়া শুল্কনীতির বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিচ্ছে বিভিন্ন বাণিজ্য অংশীদার। চীন ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-তে একটি মামলা দায়ের করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও নতুন শুল্কের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
কানাডাও দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। দেশটি ৩০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারের মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে এবং আরও ১২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত গাড়ির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যার ফলে জেনারেল মোটরস, ফোর্ড এবং টেসলার মতো বড় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, এই নতুন শুল্কনীতির প্রভাবে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ দুই দিনে ২,২০০ পয়েন্টের বেশি পতন ঘটিয়েছে এবং বাজার মূল্য ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার কমে গেছে। ন্যাসডাক সূচক ডিসেম্বরের সর্বোচ্চ থেকে ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জেপি মরগ্যান ৬০ শতাংশ এবং গোল্ডম্যান স্যাকস ৩১ শতাংশ মন্দার আশঙ্কা করছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বর্তমানে স্ট্যাগফ্লেশন বা স্থবির প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সম্মিলিত অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। ফেডারেল রিজার্ভ যদি অর্থনীতিকে চাঙা করতে সুদের হার কমায়, তাহলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। আবার মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হলে অর্থনীতি আরও স্থবির হয়ে পড়বে। এই দোটানায় যুক্তরাষ্ট্রের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, কলেজ অব ডুপেজ, ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র।