যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় ফিরল মধ্য–বামপন্থী লেবার পার্টি। ১৪ বছরের টোরি শাসনের অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল বিজয় পেল কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টি। ভোটে ‘পরিবর্তনের’ ডাক দিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী। পরাজয় মেনে নিয়েছেন সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন অন্তত ৩২৬টি। সেখানে লেবার পার্টি পেয়েছে ৪১২টি। আর ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১টি। খবর বিডিনিউজের।
বিজয়ের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে দেওয়া প্রথম ভাষণে দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশ পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। রাজনীতিকে জনগণের সেবায় ফিরিয়ে দিয়েছে।
বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বাকিংহাম প্যালেসে রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর স্টারমার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ডাউনিং স্ট্রিটে যান। ভাষণের শুরুতেই তিনি দেশের প্রথম ব্রিটিশ–এশীয় প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঋষি সুনাকের অর্জনের কথা তুলে ধরেন। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সুনাক যে ‘নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম’ করেছেন, তাও স্বীকার করেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন নতুন করে দেশ গড়া প্রয়োজন। আমরা কে তা নতুন করে আবিষ্কার করার সময় এসেছে। ইটের ওপর ইট গেঁথে দেশের অবকাঠামো পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন স্টারমার। সেই পরিবর্তন আনতে যে কিছু সময় লাগবে, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে পরিবর্তন নিয়ে আসা সুইচ টেপার মত কোনো বিষয় নয়। তবে তিনি বলেন, পরিবর্তনের কাজ অবিলম্বেই শুরু হবে। আমাদের কাজ জরুরি। আজই আমরা তা শুরু করব।
এর আগে নিজ আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ের পর ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়ে স্টারমার বলেছেন, যুক্তরাজ্যে ‘পরিবর্তনের সূচনা’ হল। এর আগে সেন্ট্রাল লন্ডনে নিজের নির্বাচনী আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ের পর সমর্থকদের সামনে হাজির হয়ে তিনি বলেন, আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনারা আমাদের দেশকে বদলে দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে ‘পরিবর্তনের সূচনা’ হল। পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে লেবার নেতা বলেন, জনগণের এই বিপুল ম্যান্ডেটের সঙ্গে বিরাট এক দায়িত্বও তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে। রাজনীতিকে আমাদের আবার ফিরিয়ে নিতে হবে জনগণের সেবায়। আমাদের সরকার দেখাবে, আমরা সবার মঙ্গলের জন্যই কাজ করছি।
২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা রক্ষণশীলদের যে ভরাডুবি হতে চলেছে, তা অনুমিতই ছিল। ৬৩৮টি আসনের ঘোষিত ফলাফলে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের দল কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১৭টি। অর্থাৎ প্রায় আড়াইশ আসন তারা হারিয়েছে। এবারের নির্বাচনের যে লেবার জোয়ার দেখা যাবে, সেই পূর্বাভাস ভোটের আগেই মেনে নিয়েছিলেন সবচেয়ে কম বয়সে যুক্তরাজ্যের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী হওয়া সুনাক। নিজের দলের বড় হারের পর তিনি সমর্থকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। নিজের আসনে রিচমন্ডে জয় পাওয়া টোরি নেতা বলেন, এই সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে লেবার পার্টি। স্যার কিয়ার স্টারমারকে ফোন করে আমি অভিনন্দন জানিয়েছি। নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি দেশের স্থিতশীলতা ও ভবিষ্যতের জন্য ভূমিকা রেখে যাবে জানিয়ে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্রিটিশ জনগণ আজ রাতে তাদের রায় জানিয়ে দিয়েছে। এখানে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের। এই পরাজয়ের দায় আমি নিজের কাঁধে নিচ্ছি।
শোচনীয় পরাজয়ের পর নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বও ছেড়ে দিচ্ছেন ঋষি সুনাক। সরকারি বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে শেষ বিদায়ী ভাষণে সুনাক বলেছেন, ভোটারদের ক্ষোভ, হতাশা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্খা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি বলেন, আমি টোরি (কনজারভেটিভ) নেতার পদ থেকে পদত্যাগ করব। তবে এখনই নয়। যখন দলের উত্তরসূরি নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে তখন। ১৪ বছর সরকারে থাকার পর কনজারভেটিভ পার্টির পুনর্গঠিত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে তারা যথেষ্ট পেশাদারিত্ব এবং কৃতিত্বের সঙ্গে বিরোধীদলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে সেটিও কম নয়। ভাষণে কিয়ার স্টারমারেরও প্রশংসা করেছেন সুনাক। তিনি বলেন, লেবার পার্টি প্রতিপক্ষ হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দলের নেতা স্টারমার একজন ভদ্র, জনহিতৈষী মানুষ। আমি তাকে সম্মান করি।
নতুন প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্ব নেতাদের অভিনন্দন : নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে য অভিনন্দন জানিয়ে একসঙ্গে কাজ করার বার্তা পাঠাচ্ছেন বিশ্ব নেতারা। ভোটের ফল ঘোষণার পর কিয়ার স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পর্ক গভীর করতে সক্রিয় অবদানের জন্য ঋষি সুনাককেও ধন্যবাদ জানান মোদী।
আইরিশ প্রধানমন্ত্রী সিমন হ্যারিস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমাদের শান্তি প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার জন্য আমি কিয়ার স্টারমারের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যমের সঙ্গে একাত্ম হব। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এঙে এক পোস্টে লেখেন, ইউক্রেন ও যুক্তরাজ্য নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে আছে। সর্বাবস্থায় সেটিই থাকবে। আমরা আমাদের জীবন, স্বাধীনতা, নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সাধারণ মূল্যবোধকে রক্ষা ও এগিয়ে নিতে যাব। কনজারভেটিভ সরকারের মেয়াদে সহযোগিতার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ এঙে লিখেছেন, ভোটের জয়ে স্যার কিয়ার স্টারমারকে অভিনন্দন। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, ইউরোপের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আমরা কাজ করে যাব। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন এঙে লিখেছেন, সাধারণ চ্যালেঞ্জগুলো ও ইউরোপীয় নিরাত্তার বিষয়গুলোতে গঠনমূলক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে আপনার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, নাগরিকদের জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়ার সব বিষয়গুলোতে কাজ করতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আপনি ও আপনার সরকার সঙ্গে কাজ করতে আমি আগ্রহী।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি আলবানিজ বলেন, আমাদের দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী সর্ম্পক। কিন্তু আমি স্যার কিয়ার স্টারমারসহ লেবার পার্টির অন্যদের সঙ্গে বেশ পরিচিত। তাদের সঙ্গে আমি কাজ করতে চাই।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এঙে লিখেছেন, যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে ঐতিহাসিক জয়ে কিয়ার স্টারমারকে অভিনন্দন। আটলান্টিকের উভয় তীরের মানুষের জন্য আরও প্রগতিশীল, সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য সামনে প্রচুর কাজ রয়েছে। চলো বন্ধু, শুরু করি।