ঘনঘোর আকাশের কোণ এককোণে বিরহী মেঘ তার আসর সাজিয়ে বসেছে, বেহাগের সুরে। তবুও শরৎ এলো, শিউলি ঝরানো শরৎ। শরৎ এলেই মনের কোণে বেজে ওঠে ফেলে আসা ছেলেবেলা। ছোট উঠোন,তার এককোণে শিউলির ডালপালা মেলা সোহাগি আবাহন। কখনো ঝরে পড়ে আছে আলোঝরা হাসিতে,কখনো অভিমানে। কুড়িয়ে তোলা এই শিউলি কখনো হয়তো লেগেছে দেবতার অর্ঘ্যে কখনো বা অবাঞ্ছিতের ঝুড়িতে। তবুও কম হয়নি তার দেয়ার দান, নিবেদনের অঞ্জলি। সবটুকু নেয়ার ক্ষমতা প্রকৃতি আমাদের দেয়নি, সবরূপ ধরে রাখবার মায়াবি আলোও দেয় নি আমাদের। প্রকৃতির অকৃপণ দান আর তার ভালোবাসা কতটুকই আমরা নিতে পারি। প্রতি ঋতু যে আলাদা রূপ আর তাকে ঘিরে রয়েছে উৎসবের আয়োজন। যা মানব জীবনে এনে দেয় ছন্দোবদ্ধতা। তেমনি শরৎ এলেই বাতাসে পূজোর গন্ধ। আমাদের ছোট্ট শহরজুড়ে শরৎ জানিয়ে দিতো তার আসার জয়ডাক। ছোট্ট শহরটা সেজে উঠতো লাল,নীল বেগুনি আলোয়। মণ্ডপের এককোণে খড়ের বেনার গায়ে লাগতো মাটির প্রলেপ, আর তাতে রঙের আঁচড়। প্রতিটি তুলির রঙে প্রাণ পেত মাটির প্রতিমা। তুলির ছোঁয়ায় কথা বলে উঠতো প্রতিমার অঙ্গ। মুখে ভেসে উঠতো মায়াবী ঠোঁট, স্নেহময় চাহনি।
ভয়ংকর সিংহ, অকল্যাণ রূপী অসুর কি অবলীলায় তৈরি করে যেতো পাল কাকুরা। মাঝেমধ্যে বিড়িটা কানের কাছে গুঁজে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতো নিজের কাজ। আর আমরা হাঁটু মুড়িয়ে বসে দেখতাম কেমন করে খড়ের প্রতিমায় জীবন্তিকার ছোঁয়া।
সে শরতে যে আকাশ গুমোট হতোনা তা কিন্তু নয়! তখন রোদমেদুরের খেলা চলতো। সে বৃষ্টি যেন শরতের উৎসবে খুব বেশি আপন হয়ে উঠতে পারতো না। কারণ তখন পুরো আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ভেলা,সাদা শিউলি তলা,কাশের হাতছানি। এখন আর তেমন সুরে শরৎ আসে না। দূরে সুরে ভেসে আসা বীরেন্দ্র ভদ্রের চণ্ডীপাঠও তেমন বাজে না। কোলাহল করে শিশুর দল মন্ডপে ভীড় করে প্রতিমাও দেখে না। বানিয়ে বানিয়ে ভয়ংকর গল্পেরা আর জায়গা করে নেয় না তাদের কথার ঝুড়িতে। দর্জিবাড়িতে একথানের কাপড়ে সবার জামা কাপড় সেলাই হয় না। বদলে গেছে হাওয়ার তালে অনেক কিছু। সহজ সরল ভাবনাগুলোতে এখন উইপোকা’র বাস। যা কেটে কেটে ক্ষত করছে। যান্ত্রিকতার ভীড়ে যেখানে উৎসব কেবল দায়সারাদের দলে। তবুও ছেড়ে আসা সময়রা নীরবে আটকে থাকে মনের কোণে, যা জানান দেয় শরতের পুঞ্জ মেঘে, বর্ষার ধারায়।