জনারণ্যের ভীড় ও কোলাহল থেকে নির্বাচিত কিছু মৌলিক মুখাবয়ব, সুকৃতীর আলোকে যারা বরেণ্য-স্মতব্য; তাঁদের জীবনচরিত এই গ্রন্থ। প্রাজ্ঞ আইনবিদ সনিষ্ঠ দ্রুতরেখ আঁচড়ে এই চরিত্রসমুদয় ফোকাস করেছেন ঘনিষ্ঠ ও তন্নিষ্ঠ অবলোকনে, অন্তর্বীক্ষণে। উদ্দিষ্ট চরিত্রের আন্তঃসত্য ও কর্মপরিধির আলেখ্য সহজ-আটপৌরে-অনায়াস ও গতিশীল গদ্যে ও সভাষ্যে বাজায়। তৃণমূল ইতিহাস অনুসন্ধান, পাঠ ও গবেষণায় গ্রথিত উপাদানসমূহ আশা করা যায়। উত্তরকালে তথ্যসূত্র বিবেচিত হবে।
বক্ষ্যমাণ উদ্ধৃতি অতি সম্প্রতি প্রকাশিত এ.এম. জিয়া হাবীব আহসান, এডভোকেট রচিত যাদের ভুলব না গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে মুদ্রিত। রয়াল সাইজের বিশাল এই ভলিউম সমকালীন ঘটনা-বাস্তবতা, জীবন-ব্যক্তিত্ব, সমাজ-রাজনীতি, ইত্যাদির ইতিবৃত্ত– বলা যায় আকর। বর্তমান বা নিকট-অতীতের প্রসঙ্গে ও প্রেক্ষাপটে, পূর্বসূরী বা পরম্পরার আলোকে অত্র গ্রন্থের রচয়িতা বিস্মৃতির অতল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তথ্য ও সত্য। যেমন- আমরা হয়ত অনেকেই জানি না পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর একান্ত সচিব এবং বিভাগ পূর্বকালের ডেইলি স্টার অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক মুসা মিয়া চট্টগ্রাম-জাত। তিনি ১৮৭২ সালে মিরসরাই থানার পূর্ব দুর্গাপুর মিঠাছড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অধুনাবিলুপ্ত এই যশস্বী সাংবাদিক ১০৫ বছর বয়সে ১৯৭৭ সালে আশকারদীঘির পশ্চিম পাড়ের নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রামাণ্য দলিলপত্রে পাওয়া যায় চট্টল গর্ব এই কৃতীজন সংস্পর্শে এসেছিলেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আকরাম খাঁ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোঃ. আলী জিন্নাহ, ডা. রোনাল্ড রস (ম্যালেরিয়ার জীবাণু আবিষ্কারক) সহ আরো আরো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের। এ.এম জিয়া হাবীব আহসান প্রত্ন-সন্ধানীর অভিনিবেশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতায় সমুজ্জ্বল এরকম অনেক হীরকখণ্ড আবিষ্কার করেছেন ।
যাদের ভুলব না গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো বিশ্ববিশ্রুত তারকা- যেমন উপস্থাপিত হয়েছে, সমান্তরালে স্বল্পালোকিত গুণী সংগীতশিল্পী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম (কিংবদন্তি আবু কাওয়ালের পুত্র) বা দুর্দম্য লড়াকু ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর অবস্থান চিহ্নিত করেছেন তিনি। লেখকের জবানি : শুধু বরণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে লেখা সন্নিবেশিত হয়নি, যারা বেঁচে আছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাচ্ছেন, সেসব শ্রদ্ধাভাজনদের নিয়েও দু’একটি লেখা সংযোজিত হয়েছে। এ ভিত্তিতে সর্বমোট ৯৪জন স্মরণীয় ব্যক্তির অবদান জিয়া হাবীব আহসান নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন তার পরিবারের কতিপয় সদস্য, যেহেতু পেশাগত জীবনে তিনি একজন ব্যবহারজীবী তাই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইনজ্ঞ-যারা তাঁদের কর্মে-কৃত্যে বরেণ্য; আছেন কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, শিক্ষাব্রতী, শিল্পোদ্যোক্তা, সুফি-কামেল পুরুষ, সমাজকর্মী আরো বিবিধ পেশার গুণিজন। অনমনীয় শ্রম ও নিষ্ঠায় জিয়া হাবীব এই জীবনচরিত রচনা করেছেন। অজস্র অজানা তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন লেখক। যেমন তার পিতা খ্যাতনামা আইনবিদ এডভোকেট আবু মোহাম্মদ য়্যাহয়্যাকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্যে ২টি স্বর্ণপদক ও নগদ অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো। বস্তুত, লেখার সঙ্গে রচয়িতার ব্যক্তিক সম্পর্ক রিপোর্টাজধর্মী রচনার সঙ্গে পাঠকের নৈকট্য নিবিড় ও ঘনীভূত করে। এ-কারণে অত্র গ্রন্থের প্রায় প্রতিটি লেখায় জিয়া হাবীবের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক ও স্মৃতির রূপরেখা হয়েছে তাই কমিউনিকেটিভ।
আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য– যেহেতু চরিত্র নির্বাচনে কোনো নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা নেই, তাই বিবিধ বিচিত্র মতাদর্শের আলোকিত মানুষের উপস্থিতি যাদের ভুলব না গ্রন্থের প্রাণসম্পদ। এখানে যেমন এসেছেন- সাত্তিক শিক্ষাবিদ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, বুজর্গ শিক্ষক মৌলভি হাফিজুর রহমান, তেমনি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্থান পেয়েছেন শিল্পপতি মির্জা আহমদ ইস্পাহানি, সুফি মিজানুর রহমানের উত্থান ও সাফল্যের তাবৎ বৃত্তান্ত। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ও মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর পাশাপাশি স্বকীয় মহিমায় দীপ্র বদরুল হুদা চৌধুরী, নজির আহমদ, মোহাম্মদ নোমানের মতো তুখোড় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। এই পুস্তক পাঠে আমরা জানতে পারবো- ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত রোকেয়া হায়দারের স্বামীকে ৭১ সালে ফয়েজ লেকের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। যথাযোগ্য মর্যাদায় উঠে এসেছেন আধ্যাত্ত্বিক সিদ্ধ পুরুষ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারি রাসূলনোমা পীর হযরত শাহ সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রা.)’র ভাববিশ্ব। এতো এতো বর্ণাঢ্য চরিত্র এই জীবনচরিতে এসে ভর করেছে- যা বিস্ময়কর ।
এই মূল্যবান গ্রন্থ সম্পর্কে প্রকাশিত জামাল উদ্দিন- এর ভূমিকার মধ্যে যাদের ভুলব না’র মৌল সত্য ও সারাৎসার প্রতিফলিত। তিনি সুস্পষ্টভাবে লেখেন- ‘সুলেখক বলেই এত অসাধ্য কাজটি সমাধা করতে পেরেছেন। যা ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষায় নতুন প্রজন্মকে আলোর মুখ দেখাবে।
বিগতকালে আম্বিকা চরণ চক্রবর্তী, মাহবুব-উল-আলম, শাহেদ আলী, আবদুল হক চৌধুরী, ওহীদুল আলম প্রমুখ চট্টগ্রামের কৃতী ব্যক্তিদের নিয়ে জীবনী রচনা করেছেন। এই তালিকায় সংযোজিত হলো সৃষ্টিশীল এ.এম. জিয়া হাবী আহসান। যেহেতু তিনি একজন প্রকৃত জহুরী তাই তার কাছ থেকে প্রত্যাশার পরিসীমা উত্তুঙ্গ। আশা করছি- তার এই মিশন ও ভিশন অব্যাহত থাকবে ।
চমৎকার ঝকঝকে ছাপা ও বাঁধাইসম্বলিত মুদ্রণ পারিপাট্যে সমৃদ্ধ ‘যাদের ভুলব না’ গ্রন্থের নয়নলোভন, শিল্পিত প্রচ্ছদ করেছেন মেরুন হরিয়াল। গ্রন্থটির প্রকাশক- বলাকা প্রকাশন। মুল্য ৮০০ টাকা মাত্র।