দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকারী হিটলারের মতই তাঁর প্রচার মন্ত্রী গোয়েবল্্স্্ও মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। ডাহা মিথ্যাকে অকল্পনীয় বিশ্বাসযোগ্য রূপে প্রচার করার বিষয়ে তিনি ছিলেন পারাঙ্গম। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর প্রতিপক্ষ মিত্র বাহিনীর আক্রমণে তাঁর দেশের নাৎসী বাহিনীর অনেক বিপর্যয়কর অবস্থাকে খুবই উত্তেজক, আবেগপূর্ণ এবং অনুপম ভাষায় জার্মানীর বিজয় বলে প্রচার করে জার্মানবাসী এবং জার্মানীর অনুগামী দেশ সমূহকে উদ্দীপ্ত করে রাখতেন। তাঁর নীতি ছিল, ‘একটি মিথ্যাকে বার বার সত্য বলে প্রচার করে যাও – এক সময় সেটি সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।’ আজ মানুষ মিথ্যাবাদী হিসাবে গোয়েবল্্স্্ এবং বিশ্বাসঘাতক হিসাবে মীরজাফরকে উপমা বা উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। গোয়েবল্্স্্ এবং মীরজাফরের হুবহু অনুসারী, কুটবুদ্ধি সম্পন্ন এবং ক্রিমিনাল মনোভাবাপন্ন, পরশ্রীকাতর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হিসাবে ‘শেখ হাসিনা’ নামটি ইতিমধ্যেই এই দুই ব্যক্তির সমার্থক হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
শেখ হাসিনার গায়ে পড়ে ঝগড়া করা এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতার কয়েকটি কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন খালেদা জিয়া কোথায় ছিলেন সে বিষয়ে শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে অনেকবার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। শেখ হাসিনার এই বোধটুকু নেই যে, তাঁর এই কুরুচিপূর্ণ আর অশ্লীল ইঙ্গিতের পরিপ্রেক্ষিতে যে কেউ ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শেখ হাসিনা কোথায় বসবাস করেছিলেন যে প্রশ্ন করে বসতে পারে। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এমন কোন অশ্লীল এবং অসৌজন্যমূলক মন্তব্য বা ভাষা নেই যা তিনি খালেদার প্রতি ব্যবহার করেননি। সেনানিবাসের মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করার সময় নাকি মদের বোতল পাওয়া গিয়েছিল, আর সেই মদ খেয়ে খালেদার লিভার পচে গিয়েছে। ৫ই আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের দিন গণভবনে যে বিদেশী মদ উদ্ধার হয়েছিল সেগুলি নিশ্চয় আকাশ থেকে পড়েছিল? মঈনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের পর হাসিনা বলেছিলেন, ‘দিয়েছি বাড়িছাড়া করে’। ‘খালেদা জিয়া এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন’–একথা হাসিনা প্রায়ই বলতেন। এতিমের টাকা ব্যাংকের যথাযথ হেফাজতে আছে এবং সেই টাকা এখন মুনাফাসহ দ্বিগুণেরও বেশী হয়েছে। এতিমের টাকা আত্মসাৎ নিয়ে হাসিনার এই মিথ্যাকে অবিরাম সত্য বলে প্রচার করে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি গোয়েবল্্স্্’র প্রচার কৌশলের অনুকরণ। এদেশের আদালতে এই স্বচ্ছ বিষয়টি নিয়ে মামলা হয়, সেই মামলায় খালেদার সাজা হয়, এর বিরুদ্ধে আপীল করা হলে উচ্চ আদালতে সাজা দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতের শাস্তির বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গেলে শাস্তি কমার কথা, কিন্তু সেটা দ্বিগুণ হয়ে এক অভিনব নজির সৃষ্টি করা হয়। এখন যদি আলেকজান্ডার বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনি তাঁর সেনাপতি সেলুকাসের উদ্দেশ্যে এ বিষয়ে নিশ্চয় কিছু বলতেন।
২০২৪ সালে খালেদা জিয়া বেশ কয়েকবার জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অসংখ্যবার বিদেশ নেওয়ার জন্য তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে অনুমতি চাওয়া হলেও শেখ হাসিনার প্রতিহিংসার কারণে বিদেশ গিয়ে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। বরং এভারকেয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন মৃত্যুপথযাত্রী খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতাকে হাসিনা উপহাস ও বিদ্রুপ করে বলেছিলেন ‘এই মরেতো সেই মরে, মরি মরি করেও মরে না’। সামান্যতম মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন কোন মানুষ এক মরণাপন্ন রোগী সম্পর্কে এজাতীয় কথা বলতে পারেন কি? এত অত্যাচার, এত লাঞ্ছনা–গঞ্জনা আর দুর্ব্যবহারের পরেও আজ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার মুখে শেখ হাসিনার সম্পর্কে কোন প্রকার অসৌজন্যমূলক একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। তিনি আপাদমস্তক রুচিশীল এবং মার্জিত ব্যক্তিত্বের মহিলা হিসাবে নিজের পরিচয় সমুন্নত রেখেছেন। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনা কুরুচিপূর্ণ উক্তি, অমার্জিত আচরণ এবং দানবীয়তার প্রতীক হিসাবে নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন জনগণের মাঝে। বিধাতার বিচারে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যাকে এতদিন অপমানিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, দমিত আর অবনত করে রাখা হয়েছিল, সেই খালেদা জিয়া আজ শির উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে দেননি। কিন্তু রাজকীয় কাতার সরকার অত্যন্ত সম্মান জানিয়ে তাদের অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুবিধা সম্বলিত এয়ার এম্বুলেন্স খালেদা জিয়াকে লণ্ডন নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। লক্ষ জনতা ঢাকা বিমান বন্দরে উপস্থিত হয়ে তাঁকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানিয়ে বিদায় দিয়েছেন। আর শেখ হাসিনা অত্যন্ত সঙ্গোপনে তড়িঘড়ি করে মালবাহী সামরিক বিমানে চড়ে সেনা প্রধানের অনুকম্পায় দেশত্যাগ করেছেন। মানুষকে অসম্মান ও অপদস্থ করা, কণ্ঠে, দৃষ্টিতে এবং মুখাবয়বে অহংবোধ লালন করা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা, অসাধুতা, আর মিথ্যাচার ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে শেখ হাসিনা ভারতের অঙ্গরাজ্যসমূহের মুখ্যমন্ত্রীদের মতই বিগত ১৬ বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থরক্ষা করে এসেছেন। বিনিময়ে ভারত হাসিনা, তাঁর পরিবার এবং তাঁর দলকে দিয়ে এসেছে প্রশ্নহীন নিরাপত্তার ছত্রছায়া। তাইতো শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবার ও দলীয় লোকজন এতই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল যে তারা গত ১৬টি বছর বাংলাদেশটাকে লুটেপুটে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আজ এটা প্রতিষ্ঠিত সত্যি যে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল ছিল না, এটা ছিল কিছু লোক সমন্বয়ে গঠিত একটা লুঠপাট সমিতি। এই সমিতির বড়, সেজ, মেজ, ছোট সব নেতারা তাঁদের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়ে তাদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে নিজ দেশ থেকে লুণ্ঠিত অর্থে নিজেরা নিরাপদ আস্তানায় আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন।
বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়ে হাসিনার মুখ থেকে কখনো একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। ভারতের এক সময়ের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এবং হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জনের আমাদের দেশের বিষয়ে নাক গলানো এবং দাম্ভিকতাপূর্ণ উক্তি ও আচারণ এতই খোলামেলা ছিল যে, দেশের মানুষ এতে ক্ষুব্ধ হলেও শেখ হাসিনা ছিলেন রহস্যজনকভাবে নির্বিকার। ভারত কর্তৃক এদেশের প্রতি অবমাননা সুলভ বক্তব্য ও আচরণ, সীমান্ত হত্যা, সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়ার নামে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি ইত্যাদির বিষয়ের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে হাসিনার কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে মানুষ হতাশ হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বলেন, ভারতের মুসলিম মহিলারা খুব বেশী সন্তান জন্ম দেয়, তখন ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে এদেশের মুসলমানরাও ব্যথিত হয়। নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের প্রতিবাদ হাসিনা করতে না পারলেও অল ইন্ডিয়া মুসলিম কমিউনিটি মোদির মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল যে মোদির মা সাত সন্তান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মা নয়জন সন্তানের জননী। বিগত ১৬ বছর বাংলাদেশে চলেছে আলেম নিপীড়ন। বহির্বিশ্বকে দেখানোর জন্য দেশে জঙ্গী আর আতংকবাদী ধুয়া তুলে ইসলামী পোশাকধারী পুরুষ ও মহিলাদের নির্বিচারে গ্রেফতার আর নির্যাতন করে এদেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলা হয়েছিল। শুক্রবারে জুমার নামাজের সময় মসজিদে গোয়েন্দা বিভাগের লোক উপস্থিত থাকত। ইমামগণ জুমার নামাজে স্বাধীনভাবে খুতবা দিতে পারতেন না। আরবী বই, নামাজ শিক্ষার বই বা যে কোনো ধর্মীয় বই পাওয়া গেলে বলা হত জেহাদী বই, মিলাদ মাহফিল হলে বলা হত নাশকতার জন্য প্রস্তুতি সভা, তফসীরুল কোরান মাহফিল করা যেত না। এক কথায় মানুষের বাক স্বাধীনতার সাথে ধর্মকর্মের স্বাধীনতাকেও শৃঙ্খলিত করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই হিটলারের রাজনৈতিক দলটি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল যা আজ ৮০ বছর পরও বলবৎ রয়েছে। সে সময়ের মানবতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পাওয়া গেলে এখনো তাদের বিচার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ৫ই আগস্ট ২০২৪ আমাদের দেশের ঘটে গেছে বিশ্বে নজিরবিহীন এক অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের পতিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য সর্বত্র দাবী উত্থাপিত হলেও ২/১টি দল এর বিরোধিতা করছে। এমনকি এরা আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনেও অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলছে। এসব দল নিজেদের অতি গণতান্ত্রিক দেখাতে গিয়ে দেশবাসীর তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে। কোন রহস্যজনক কারণে কয়েকটি দল নিজেদের এই অতি উদারতা প্রদর্শনে সচেষ্ট। তারা অতি দ্রুত নির্বাচন এগিয়ে আনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার কোনই আবশ্যকতা নেই। যারা এসব করার জন্য চাপ দিচ্ছে তারা সারা দেশের মানুষের কাছে চিহ্নিত হয়ে পড়ছে। আগের গড্ডালিকা প্রবাহের দিন গত হয়েছে। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী সচেতন ও সজাগ জনগণ পতিত সরকার ও দলের প্রতি কোন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর উদারতা প্রদর্শনকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কোনো দুরভিসন্ধিতে যুক্ত হলে তাদের স্থানও আস্তাকুঁড়ে হবে।
লেখক : বর্ষীয়ান নাগরিক ও সমাজকর্র্মী