বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে পরিবহনে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য কিছুতেই থামছে না। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশের ইতিহাসে সাড়া জাগানো সর্ববৃহৎ ছাত্র আন্দোলনের পরে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সড়ক পরিবহনের নতুন আইন করল। আইন বাস্তবায়নও হলো। কিন্তু পরিবহনে বিশৃঙ্খলা শুধু বাড়ছেই। শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে যাত্রী অধিকার দিবসের সভায় সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, পরিবহন খাতসহ দেশের সব ক্ষেত্রে বৈষম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছাত্র–জনতার শত সহস্র তাজা প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাতেও দীর্ঘদিন যাত্রী সাধারণ ছিল বঞ্চিত। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে তাদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, পরিবহনের প্রধানতম স্টেকহোল্ডার দেশের জনগণ তথা যাত্রী সাধারণ। যদিও আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৬ বছর পরিবহন পরিচালনার সব ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার যাত্রী সাধারণের প্রতিনিধিত্ব বাদ দিয়ে সরকারের অনুগত লেজুড়বৃত্তি একটি বাস মালিক সমিতি ও একটি পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতৃত্বে পরিবহন সেক্টর পরিচালনা করা হয়েছে। ফলে পরিবহনে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা, ভাড়া নৈরাজ্য, যাত্রী হয়রানি অস্বাভাবিক হারে শুধু বেড়েছে।
তাদের এই বক্তব্য খুবই যুক্তিযুক্ত। বর্তমানে নগরীতে দিন দিন বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। রয়েছে অসহনীয় যানজট। দুর্ঘটনা এড়াতে মোটরযান আইন থাকলেও তা তোয়াক্কা করছে না অনেকে। জনসাধারণের সচেতনতার অভাব, চালকদের অসতর্কতা, অবহেলা, আইন–কানুন না জানা, ট্রাফিক পুলিশের অপ্রতুলতা এবং আইন বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকাই এর মূল কারণ হিসেবে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। একদিকে যেমন সাধারণ জনগণ ট্রাফিক আইন মেনে চলছেন না ঠিক তেমনি তা অনুসরণ করছেন না চালকরাও। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার পাশাপাশি নতুন করে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথা অনুভব করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, বিশ্বে সকল বয়সের মানুষের মৃত্যুর ৮ম প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। এর কারণে প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ মারা যান। একই সাথে ৫–২৯ বছর বয়সের শিশু ও তরুণদের মৃত্যুর প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ। তাঁরা আরও বলেন, সড়ককে নিরাপদ করার জন্য জাতিসংঘের কৌশলপত্রে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো, সড়ক নিরাপদ করতে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ যানবাহনের ব্যবস্থা, সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, রোডক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা ও যান চলাচলের নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে সড়কে এখন শৃঙ্খলা নেই। প্রতিদিন মৃত্যু আছে, আছে বিশৃঙ্খলা।
বর্তমানে নগরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। দিন যত যাচ্ছে সমস্যা তত প্রকট হচ্ছে। যানজট ক্রমশ দুর্বিষহ করে তুলেছে জনজীবন। নষ্ট হচ্ছে মানুষের শ্রম ঘণ্টা। পুড়ছে জ্বালানি। নষ্ট জ্বালানিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড়গুলোর এক–তৃতীয়াংশই বর্তমানে গণপরিবহন, প্রাইভেট গাড়ি, সিএনজি টেক্সি, রিকশা, ভ্যান ও ভ্রাম্যমাণ হকারের দখলে থাকে। এতে সাধারণ যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে চরমভাবে বিঘ্ন ঘটছে। স্কুল ছুটির সময় অবৈধভাবে পার্কিং করে রাখা ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে যানজট অসহনীয় হয়ে ওঠে। এছাড়া পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ৪০টির বেশি অনুমোদনহীন রুটে অবৈধভাবে চলছে নিবন্ধনহীন কয়েক হাজার গাড়ি। সেইসঙ্গে দাঁড়িয়ে গণপরিবহনে যাত্রী ওঠানামা এবং একই রুটের অন্য গাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলছে। সব মিলিয়ে সড়কজুড়ে যানবাহনে এখন চরম নৈরাজ্য। এসব কারণে সড়কে যানজটের পাশাপাশি বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সতর্কতা ও সচেতনতার অভাব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির অন্যতম প্রধান কারণ হওয়ায় পথচারী, যাত্রী, চালক, সবাইকে সচেতন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। গণমাধ্যমে এমনভাবে প্রচারণার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে সবাই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে পথচারী ও যাত্রীদের অধিক সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। তারা সচেতন হলে প্রায় অর্ধেক দুর্ঘটনা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।