শশীভূষণ তাঁর দলের নাম রেখেছিলেন ‘বহুলক্ষ্মী যাত্রা সমিতি’। বাবুরা টিটকারী দিতেন ওহে শশীভূষণ, তুমি ভদ্রলোকের সন্তান হয়ে যাত্রাদল বানাবে কি হে ? যাত্রা তো করবে ফাৎরা লোকে। ওকালতি পাশ করেছো, জমিজমা নিয়ে মাথা ঘামাও শশীভূষণ। শশীভূষণ তবু পিছপা হননি, সাজপোশাক, করনেট, ড্রাম, তবলা, মৃদঙ্গ সবকিছু কিনে এনে তাঁর চক্রশালার বাড়িতে দিন রাত মহড়ায় মেতে থাকতেন। তাঁর দলের প্রতিটি শিল্পী ছিলো আগুনে ঢালাই করা। যার ভেতর অভিনয় প্রতিভা দেখতেন, তাকেই তিনি ধরে আনতেন। যাত্রায় নারীর অভিনয় দৃষ্টিকটু , কিন্তু তাঁর দলের অভিনয় দেখে, নারী চরিত্র দেখে কেউ বুঝতে পারতো না। খুদিরামের মা ছিলো হাশিমপুরের রামনাথ যুগী বা সীতাহরনের সীতা নিমাই চরনকে দেখে মহিলারা পর্যন্ত হিমশিম খেয়ে যেতো।
তখন যাত্রায় সিরাজদ্দোউলার যুগ। বাংলার হৃদয় থেকে নির্গত হচ্ছিলো তরুণ নবাবের মর্মান্তিক নাট্য কাহিনী । শশীভূষণ মহড়ায় গিয়ে মুশকিলে পড়লেন আলেয়াকে নিয়ে। সুদর্শন নিমাই চরন জলদাসকে আলেয়া মানায়, কিন্তু সে নাচতে জানে না।
একটি নাচ গান জানা ছেলের জন্যে বেরিয়ে পড়লেন শশীভূষন। তখন চড়ক পূজার হিড়িক। শিব গৌরি ঘরে ঘরে এসে নাচতে নাচতে গান ধরে।
অ শিব সদাই পাগল
গোইরার লাগিয়া শিবের বাপ নাইরে
সংগে সংগে ঢোল কাশীর শব্দ। শশীভূষন এখান থেকে আবিষ্কার করলেন গৌরী সাজা একটি ছেলেকে। নাম মানিক, পটিয়ার বিপিন কুমোরের একমাত্র সন্তান।
বিপিন মাটির পুতুলে রঙ লাগাচ্ছিলো, মেলায় সেগুলো বিক্রি হবে। শশীভূষনের দিকে চেয়ে এক গাল হেসে বললো, কর্তা অরে লইয়া যান, হারামজাদাটা আমার কথা শোনে না, পুতুলও বানায় না। অর মার মরনের পর থাইকা ক্যামন জানি উদাস হইয়া গ্যাছে। দিনরাত্র বাইরে বাইরে নাইচ্চ্যা বেড়ায়।
মানিককে নিয়ে এলেন শশীভূষন। ছেলেটা যেন খাঁটি মাটি, যে কোন ছন্দে ও রূপে মূর্ত হয়ে ওঠে। তার আলেয়ার অভিনয় দেখে গ্রামবাসীরা থ। যেমন নাচ, তেমন অভিনয়, তেমনি গান।
মানিককে পেয়ে শশীভূষণ তাঁর ‘বন্দিনী মাতা’র রূপ দিলেন সঙ্গীত ও নৃত্যের মধ্য দিয়ে।
‘মাতা অধীনতার শৃঙ্খলে বন্দিনী। চোখে বিচ্ছুরিত অঙ্গার, চুল অবিন্যস্ত, মুখ যন্ত্রণায় নীল। বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে তার সন্তানদের, তাঁর যন্ত্রণা কান্নার,পাপিষ্ঠরা তাঁর মুক্তিকামনাকে পদদলিত করে তাঁকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে, তাঁর অঙ্গার মুক্তির। দূর থেকে তাঁর সন্তানেরা ডাকে, তিনি চমকে সাড়া দেন, সন্তানেরা কেঁদে বুক ভাসায়, তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন, তাঁর সন্তানেরা সম্মিলিত সঙ্গীতে এগিয়ে আসে, তিনি শৃঙ্খলমুক্ত হন। ‘হাততালির পর হাততালি। কাঁপে মাটি কাঁপে হাওয়া, কাঁপে অন্ধকার। শ্রীপুরের মানীলোক নবীন মাষ্টার সাজ ঘরে এসে বলেন শশীদা, তোমার স্বপ্ন এতদিনে সার্থক হলো । তুমি ঠিক পথ বেছে নিয়েছো।
যাত্রা দলের সবার দিকে হাত ইশারা করে জবাব দেন শশীভূষন এরাই আমার স্বপ্ন। এরা যেদিন মরে যাবে সেদিন আমার স্বপ্নও মিলিয়ে যাবে। নবীন মাষ্টার বলেন তুমি বড্ড অভিমানী শশীদা। কাদের গায়ে খোঁচাটা তুমি দিলে তা আমি জানি। আমাদের দেশের সৌখিন বাবুরা যাত্রাদলের পৃষ্ঠপোষক হলো না তার কারণ, তাঁরা নব্য আধুনিকতার মোহে পীড়িত। তাঁদের কাছে কতোটুকুই বা তুমি আশা করতে পারো। শশীভূষন বলেন কিছুই না। আমি নীচু জাতের লোকদের নিয়ে যাত্রাদল করেছি, আমার বিকার ঘটেছে, ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে আমি উচ্ছন্নে গেছি এসব তিরস্কার ছাড়া আর কিছুই আমি তাদের কাছ থেকে আশা করতে পারি না।
নবীন মাষ্টার বলেন শশীদা, তোমার মতো গুণী লোকের দলকে কউ না চিনুক, আমরা তো চিনি। তারপর তিনি মানিকের দিকে তাকিয়ে বললেন বেশ নেচেছো তুমি। বন্দিনী মাতার শেকল ছেঁড়ার যে রূপ তুমি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছো তার তুলনা নেই। এই নাচটা তুমি আমার মেয়ে তাপসীকে শিখিয়ে দাও। দেবে তো? শশীভূষণ বললেন নিশ্চয়ই দেবে। আমরা যে কয়দিন এই গ্রামে আছি, রোজ মানিক গিয়ে তোমার তাপসীকে এই নাচ শিখিয়ে দিয়ে আসবে।
এরপর থেকে মানিকের জীবনে উড়ে এলো এক টুকরো মেঘ। যে মেঘে আছে আকাশের হাতছানি, আছে হারিয়ে যাওয়ার বিশালতা।
জীবন কি মানিক তা জানে না। সে যাত্রাদলের মেয়ে অভিনেতা আর নাচিয়ে, যার নাম নাটুয়া। জীবন বলতে মানিক শুধু বোঝে, নাচ গান আর অভিনয়। কিন্তু রোজ নবীন মাস্টারের মেয়ে তাপসীকে নাচ শেখাতে গিয়ে তার মনে হাওয়া এসে লাগে আরেক জীবনের ।
নবীন মাস্টার একদিন বলে বসলেন মানিক তুমি বাইরে কোথাও চলে যাও। মনীপুরী, ভরত নাট্যম, কথাকলি শিখতে পারলে তুমি একজন বিরাট নৃত্যশিল্পী হতে পারবে। কথাটা দাগ কাটলো মানিকের মনে। কিছুদিন পর তাকে আর খুঁজে পাওয়া গেলোনা।
এক বেগুনী সন্ধ্যায় বিপিন কুমারের দাওয়ায় এসে দাঁড়ালেন শশীভূষন জিজ্ঞেস করলেন, মানিক এসেছো? বিপিন গাঁজায় দম মেরে বসে আছে, চারপাশে মাটির পুতুলের ছড়াছড়ি, পলকহীন চোখ দুটো তুলে জবাব দিলো না কর্তা আসে নাই। আপনার লগে হেই যে গ্যাছে আর আসে নাই। হারামজাদা আমারে ভুইল্যা গ্যাছে। জানেন কর্তা, মানিক আমাদের ছেইলা নয়। মুহূর্তে চমকে ওঠেন শশীভূষন, বলেন, তবে মানিক কার ছেলে?
গাঁজার নেশায় কথার ফুলঝুরি বেরোয় বিপিনের মুখ থেকে। ভাসতে ভাসতে কি করে সে পালিয়ে এসে ডেরা বেঁধেছিলো এই পটিয়ায়, তার কাহিনী, যা কেউ জানে না, যা কোনদিন সে কাউকে বলেনি। মানিক তার সন্তান নয়, মানিকের মাও তার স্ত্রী নয়। বিপিন বলে–মানিকের মা অপরূপা সুন্দরী, অমন সতী নারী পৃথিবীতে জন্মায় না। মানিক হলো কুমিল্লার রতন পটুয়ার ছেলে। রতন পটুয়াকে চেনেন না কর্তা ? নাম শোনেননি ? আহা তুলির টানটা কতো নিখুঁত? কর্তা উনিই আমার গুরু। বলেছিলেন বিপিন–তুই পট আঁকা ছেড়ে মাটির কাজ ধর। পটুয়া হতে গেলে সারা জীবন না খেয়ে মরবি । ঠিকই বলেছিলেন কর্তা , রতন পটুয়ার আঁকা পট কথা কয়, কিন্তু সেই পট তাকে অন্ন দেয়নি। একদিন আঁকতে আঁকতেই মহাপ্রস্থান করেছিলেন। যাবার সময় বলেছিলেন, –বিপিন , আমার বউটাকে দু’বেলা ভাত দিতে পারিনি। আমাদের দেশের পটুয়ারা চিরকালই দুর্ভাগা। তাদের বউরা উপোস ক’রে ছেলেরা উলঙ্গ হয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। আমার বউ আর ছেলেটাকে অন্তত একবেলা খাইয়ে–পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখিস। মানিক বড় হলে তোর ঋণ শোধ করে দেবে।
কিন্তু কর্তা, গুরুর সেই কথা রাখতে পারলাম কই? তাঁর বউ ছেলের জন্য সংসার পর্যন্ত করলাম না, মাটির কাজ করতে করতে পটিয়ায় এসে ঘর বাঁধলাম। সবাই জানে মানিকের মা আমার স্ত্রী, কিন্তু আমি তো জানি, সেই সতীলক্ষ্মী শুধু রতন পটুয়ার তুলিতেই ধরা পড়ে। আর বিপিন কুমোরের কাজ সেই পটে আঁকা লক্ষ্মীকে জিইয়ে রাখা। কিন্তু চলে গেলো, জানেন কর্তা, এও এক রঙ রঙিনের ভেলকিবাজি। এই বলে বিপিন কিছুক্ষণ থামে। ঢোঁক গিলে আবার বলে ওঠে শুনতাছি আপনার দলে গিয়া মানিক খুব নাম কইরা ফেলাইছে। নাম করবো না? হাজার বার করবো, লক্ষ বার করবো। ছেইলা কার? এ বাচ্চা রতন পটুয়ার ছেইলা। তার রক্তে রক্তে অঙ্গে অঙ্গে রতন পটুয়া, হ কর্তা, আমার গুরুদেব রতন পটুয়া কথা কইতেছে না।
শশীভূষনের বুক থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো নদীর হাওয়ার মতো। বুঝলেন মানিককে আর তিনি খুঁজে পাবেন না।
শিল্পীরা নদীর মতো, বাঁকে–বাঁকে স্মৃতির ছোঁয়া লাগিয়ে তাঁদের যাত্রা সমুদ্রের দিকে।
(প্রথম প্রকাশ: সাপ্তহিক রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮)