যাত্রাশিল্পে ঈদের দিনগুলি

মিলন কান্তি দে | বৃহস্পতিবার , ৫ জুন, ২০২৫ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

একদা এ দেশে দুটি ঈদ উৎসবে যাত্রাদলে সে কি আনন্দউচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যেত, তা এখন কল্পনাই করা যাবে না। সেকালে এখনকার মতো যাত্রানুষ্ঠানের অনুমতির জন্যে নিয়ম কানুনের অত কড়াকাড়ি ছিল না। প্রচুর যাত্রা চলত গ্রামেগঞ্জে। ৬০৭০ বছর আগেও সাধারণ মানুষের কাছে বিনোদন বলতে ছিল যাত্রাসার্কাস। এখন যাত্রাশিল্পীদের মন থাকে প্রায় বিষণ্ন। তখন থাকত প্রাণোচ্ছল, সদা হাসিখুশি। ঈদ এলেই খুশির জোয়ারে ভাসতেন মালিকশিল্পীরা।

ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ছোটবড় সব যাত্রাদলে শোরগোল শুরু হয়ে যেত। ছোট ছেলেমেয়েরা নেচেগেয়ে বেড়াত-‘ঈদ এসেছে ঈদ এসেছে।’ কোনো কোনো যাত্রামঞ্চে ঈদের গান বাজনা শুরু হতো। সেই সময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মেলা, পার্বণে নিয়মিত শোনা যেতো যাত্রার ঢাকের আওয়াজ। দলে দলে অংশ নিত যাত্রাদলের শিল্পীরা। যাত্রা প্যান্ডেলে মাইকে বাজানো হতো নজরুলের সেই বিখ্যাত গান– ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’

যাত্রাদলে আনন্দের মাত্রা বেশি দেখা যেত কোরবানি ঈদে। জামাতের পরই যে কোলাকুলিটা হতো, সে এক অপূর্ব দৃশ্য! মুসলিম শিল্পীরা বুকে টেনে নিতেন হিন্দু শিল্পী ভাইদের। মুসলিমদের হাতের সেমাইরুটি উঠে যেত সহশিল্পী হিন্দু ভাইবোনদের মুখেও। ঈদের দিনে মাংসপোলাও খেতেন সবাই একসঙ্গে বসে। কোনো শুচিবায়গ্রস্ত হিন্দু যদি এক পাতে বসতে না চাইতেন তখন দলের অধিকারী মহাশয় হাঁক ছেড়ে বলতেন, ‘ওই ব্যাটা, শিল্পীদের আবার জাত আছে নাকিরে?’ হয়তো কেউ তখন কবি নজরুলের দুলাইন ছুড়ে দিতেন-‘হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসে কোনজন?’ আসলে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালার যে চিরায়ত আবেদন, এর মূলে রয়েছে সাম্য সম্প্রীতির আবহ। প্রতিটি দৃশ্যে, সংলাপে রয়েছে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানের পারস্পারিক সহমর্মিতা। অশুভ শক্তির প্রতিরোধে জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে বিভিন্ন যাত্রাপালায়। এসব পালায় অভিনয় করতে গিয়ে শিল্পীরা যে সৌভ্রাতৃত্বমূলক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতো, তারই প্রতিফলন ঘটতো যাত্রাদলের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্ম, দুর্গাপূজা ও ঈদ উৎসবে।

পূজার আরতি দেখার জন্য যেমন সমবেত হতো মুসলিম শিল্পীরা, তেমনি ঈদ উৎসবেও শামিল হতো হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইবোনেরা। ১৯৬০ থেকে ৭০এই দশ বছরে প্রতিটি ঈদেই যাত্রার আসর ছিল জমজমাট। সে সময়ে বিখ্যাত দল ছিল সিরাজগঞ্জের বাসন্তী অপেরা, চট্টগ্রামের বাবুল অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জয়দুর্গা অপেরা ও ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা, ময়মনসিংহের নবরঞ্জন অপেরা, গোপালগঞ্জের দিপালী অপেরা এবং সাতক্ষীরার আর্য অপেরা। ঈদে কোন্‌ দল দর্শকদের কত ভালো পালা উপহার দিতে পারবেএ নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা হতো। একবার বাসন্তী অপেরা নিয়েছিল ‘সোহরাবরুস্তম’। তাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য জয়দুর্গা অপেরা মঞ্চে নিয়ে আসে নবাব সিরাজউলদৌলা

ঢাকা শহরে কাওরান বাজারের কাছে পালপাড়া নামে একটি গ্রাম ছিল। ঈদের দিন মাইকে বাজানো হতো নির্মলেন্দু লাহিড়ির কণ্ঠে সিরাজদৌলার সেই রেকর্ড– ‘বাংলাবিহারউড়িষ্যার মহান অধিপতি ………‘ আর রাতভর চলতো যাত্রাপালা। ঈদের আনন্দ ও ভাব ব্যঞ্জনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পালাগুলো ছিল সাম্যসম্প্রীতি, যুদ্ধবিরোধী ও সৌভ্রাতৃত্বমূলক। এ ধরনের একটি যাত্রাপালা ‘চন্দ্রশেখর।’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের পালারূপ দিয়েছেন সৌরিন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়। একটি দৃশ্যে যুদ্ধে আহত প্রতাপ (এ পালার নায়ক) নবাব মীরকাসেমকে বলছে– ‘জাহাপনা এই সেই দেশ, যেখানে মুসলমানের মসজিদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুর দেবমন্দির। এই সেই দেশ, যেখানে হিন্দুর সন্ধ্যারতির শঙ্খঘণ্টার সঙ্গে মুসলমানের আযান ধ্বনি একই সাথে বাতাসে ভেসে ওঠে।’ এরপর মৃত্যুপথযাত্রী প্রতাপকে বুকে জড়িয়ে ধরে নবাব মীরকাসেমের শেষ সংলাপ– ‘যে দেশে মুসলমানের জন্য হিন্দু প্রাণ দেয়, হিন্দুর জন্য মুসলমান জীবন আহুতি দেয়সে দেশ সারা বিশ্বের অজেয়।’ সে সময়ে শুধু ঈদ উপলক্ষ্যে যে পালাগুলো মঞ্চায়ন হত সেগুলো হচ্ছে– ‘রমজানের চাঁদ’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘জাগরণ’, ‘নাচমহল’ ও ‘রাহুগ্রাস’। চাঁদ সুলতানা যাত্রাপালায় দেশাত্মবোধক একটি সংলাপ ছিল এরকম– ‘বাবা, বেতনের সঙ্গে ওজন করে সৈনিক যদি কাজ করে, বৈজ্ঞানিক যদি আবিষ্কার করে, মসীজীবী যদি কেতাব লেখে, তাহলে নদীর বুকে রথ চলবে না। আর অন্তরীক্ষে গগনচুম্বি সৌধ মাথা তুলে দাঁড়াবে না।’ ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৭১ অর্থাৎ স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট, সুচক্রদণ্ডী, কেলিশহর, ছনহরা প্রভৃতি গ্রামে ঈদ উপলক্ষ্যে যাত্রা গানের জোয়ার বয়ে যেতো। আজ পটিয়া ক্লাব ঘরটি যে সুদৃশ্য কারুকাজ করা পাকা ভবনে দাঁড়িয়ে আছে, তখন এটি ছিল মাটির তৈরি একটি সাধারণ ঘর, সেই ঘরে ঈদের যাত্রা হতো মহাসমারোহে। দর্শক টিকিট কেটে যাত্রা উপভোগ করতেন। পালাগুলোর নাম ছিল: সত্যের জয়, অসূর বধ, সমাজের বলি, দাসীপুত্র, চাষার ছেলে প্রভৃতি। এসব পালায় অভিনয় করতেন শ্যামাচরণ, বামাচরণ, হিমাংশু পাঠক, স্মৃতিশ ভট্টাচার্য প্রমুখ কীর্তিমান যাত্রাশিল্পীরা। হাল আমলে শুধু পটিয়া কেন, গোটা চট্টগ্রামেও যাত্রা নেই। তাই এখন আর ঈদের বাজনা আগের মতো বাজে না।

১৯৩০ সালে বর্তমান পটুয়াখালী জেলার দুধলগ্রামে গড়ে ওঠে মুসলিম যাত্রাপার্টি। যাত্রার ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারণ, সেকালে বেশিরভাগ যাত্রাদল, যাত্রাপালা তৈরি হতো সনাতনী ঘরানার আলোকে। যেমন গণেশ অপেরা, নটনারায়ণ অপেরা, শ্রীনাথ অপেরাএসব দেবদেবীর নামানুসারে। গোষ্ঠী বিশেষের ধর্ম বিশ্বাসের বাইরে ইসলামী চেতনায় যাত্রাপালা নির্মাণের উদ্দেশ্য নিয়ে এ দলটি গঠন করেন স্থানীয় এক সম্ভ্রান্ত ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি মোজাফফর আলী সিকদার। তিনিই প্রথম মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধ’ অবলম্বনে ৩টি পালা রচনা করেন– ‘জয়নাল উদ্ধার’, ‘এজিদ বধ’ ও ‘সখিনার বিলাপ।’ এগুলোই বিখ্যাত ‘ইমাম যাত্রা’ নামে পরিচিত। গ্রামের লোকজনদের ইমাম যাত্রা বেশি দেখানো হতো ঈদের রাতে। ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে বরিশালপটুয়াখালীবাকেরগঞ্জঝালকাঠি সব জায়গায় গ্রামে গ্রামে খবর চলে যেতো, আসিতেছে আসিতেছে ইমাম যাত্রা।

১৯৬৯ সালে বাবুল অপেরার ‘একটি পয়সা’ যাত্রাপালা বাংলার মাঠঘাট গরম করে তুলেছিল। পালাটি ছিল গণজাগরণমূলক। সেবার ঈদউলফিতরের সময় ‘একটি পয়সা’ মঞ্চস্থ হয়েছিল যশোরের বসুন্দিয়া বাজারে। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/পূর্ববাংলা স্বাধীন কর’এ স্লোগানে সারাদেশ যখন কেঁপে উঠছে, তখন ‘একটি পয়সা’ যাত্রাপালার গান ও সংলাপ পল্লীবাংলার মানুষের প্রাণে আগুন জ্বালিয়ে তুলেছিল। সেদিন অভূতপূর্ব লোকে লোকারণ্যে ছেয়ে গিয়েছিল বসুন্দিয়া বাজারে ঈদের যাত্রা প্যান্ডেল। পালার নায়ক ছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস। বুর্জোয়া চক্রের উদ্দেশ্যে তার শাণিত সংলাপ গোটা প্যান্ডেলে ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হয়-‘সাত মহলা অট্টালিকা ভেঙেচুরে কায়েম করতে হবে মেহনতি মানুষের ন্যায্য অধিকার।’ এ পালার অভিনয় এমন জমে উঠেছিল যে, পরদিন স্থানীয় যাত্রাভক্ত লোকজন তাদের বাড়িতে যাত্রাওয়ালাদের ডেকে নিয়ে এক পেট খাইয়ে দিয়েছিল। খাওয়াদাওয়ার সময় হাস্যরসিকতা হয়েছিল খুব। যাত্রাশিল্পীরা হাসতে হাসতে বলেছিলেনএকেই বলে ঈদের খাওয়া। সেকালের ঈদের খাওয়া যাত্রাশিল্পীদের ভাগ্যে আজ আর জোটে না। যাত্রার দিনগুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে। যাত্রায় ঈদের সেই সোনালি দিন এখন স্মৃতিমাত্র। যাত্রাপ্যান্ডেলে মাইকে আর শোনা যায় না নজরুলের সেই বিখ্যাত ইসলামী গান– ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’

লেখক : নাটকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ফেলো, যাত্রাশিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকী কথা কইলে তুমি
পরবর্তী নিবন্ধঈদুল আজহা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগের উৎসব