তিন দফা দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী–শিক্ষকদের মিছিল কাকরাইলে পুলিশের বাধার মুখে পড়েছে। লাঠিপেটা করে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদালে গ্যাস ছুড়ে এবং জলকামান থেকে পানি ছিটিয়ে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার পর আন্দোলনকারীরা কাকরাইল মসজিদের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। আহত অন্তত ২৫ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে বলে মেডিকেল ফাঁড়ি পুলিশ জানিয়েছে।
৭০ শতাংশ আবাসন ভাতা, বাজেট বৃদ্ধি এবং সব প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার তিন দফা দাবি নিয়ে গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয় শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি। পদযাত্রা সংক্ষিপ্ত করতে পুলিশ তাঁতীবাজার ও গুলিস্থান, জিপিও মোড়, মৎস্য ভবনে ব্যারিকেড দিলে শিক্ষার্থীরা সেগুলো ভেঙে সামনের দিকের অগ্রসর হয়। তাদের মিছিল কাকরাইল এলাকায় পৌঁছালে সেখানে তাদের পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।
আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। পরে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলনকারীরা মৎস্য ভবন মোড়ের দিকে চলে যান। পরে তারা আবারও ফিরে এসে কাকরাইল মসজিদ মোড়ে রাস্তার ওপর বসে পড়েন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, যতক্ষণ তাদের দাবি না মেনে নেওয়া হবে, ততক্ষণ তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। খবর বিডিনিউজের।
আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ল বিভাগের সাদিয়া আক্তার নেলি, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের রীতি আক্তার, ইংরেজি বিভাগের রাতুল, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আবদুল্লাহ আল ফারুক, দর্শন বিভাগের আসিফ আদনান। এছাড়া পুলিশের লাঠিপেটায় তিন সংবাদকর্মীও আহত হয়েছেন। তারা হলেন বাংলা ট্রিবিউনের সুবর্ণ আসসাইফ, দৈনিক সংবাদের মেহেদী হাসান এবং ঢাকা পোস্টের মাহতাব লিমন।
আবাসন সমস্যায় থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। সোমবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে নিয়ে ‘জবি ঐক্য’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন। সেদিন তাদের সমাবেশে দাবি আদায়ে যমুনা ঘেরাওয়ের কথা বলেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনেকে। পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল ইউজিসিতে যায়। কিন্তু ইউজিসি থেকে আশানুরূপ কোনো ঘোষণা না আসায় ওই রাতে ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা।
তাদের তিন দফা দাবি হল : আবাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি কার্যকর করতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই আন্দোলনের কারণে সব ইন্সটিটিউট ও বিভাগের চলমান ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
দাবি আদায়ে কাকরাইল মসজিদ মোড়ের অবস্থানে অনড় জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা : তিন দফা দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে পদযাত্রা করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা কাকরাইল মসজিদ মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন। পুলিশের বাধায় একদফা ছত্রভঙ্গ হওয়ার কিছু সময় পর আবার তারা সেখানে জড়ো হয়েছেন। রোদ–বৃষ্টি তোয়াক্কা না করে রাতেও আন্দোলনে অনড় রয়েছেন তারা। সড়কে অবস্থান নিয়ে সেখানে বিক্ষোভ করছেন। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস না আসা পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে তাদের সঙ্গে শিক্ষকরাও রয়েছেন।
বুধবার রাত ৮টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা কাকরাইল মসজিদ মোড় ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। তারা প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে ‘ভুজুংভাজুং বুঝি না, লংমার্চ টু যমুনা’, ‘রক্ত লাগলে রক্ত দে, তবু আমাদের আবাসন দে, জ্বালো রে জ্বালো আগুন জ্বালো’, ‘আর নয় হেলাফেলা, এবার হবে আসল খেলা’, ‘বৈষম্যের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘জবিয়ান আসছে, রাজপথ কাঁপছে’, ‘শিক্ষকদের অপমান, সইবে না রে জবিয়ান’, ‘আমার ভাই আহত কেন ইন্টেরিম জবাব দে’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
বিকাল ৪টায় ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রক্টর ও রেজিস্ট্রারসহ প্রশাসসের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষক–কর্মকর্তারা। এসময় তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রমনা জোনের পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ফলপ্রসূ কোনো আলোচনা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. রেজাউল করিমের নেতৃত্বে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিনা শরমিন, প্রক্টর অধ্যাপক মুহাম্মদ তাজ্জামুল হক ও রেজিস্ট্রার অধ্যাপক শেখ গিয়াসউদ্দিনসহ প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাতে যান।
এদিকে যমুনাতে যাওয়ার সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাদা দলের নেতা অধ্যাপক মো. মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগ ওঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। এর প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোশাররফ বলেন, এভাবে তো আমাদের অপমান করতে পারে না। আমরা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তারা দুপুর থেকে আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে অসদাচরণ করে যাচ্ছে। তিনি হামলা ও অসদাচরণ করা পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ ছাড়াও শিক্ষকদের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে পুনরায় যান। রাত ৮টা পর্যন্ত তারা সেখানেই ছিলেন। অপরদিকে শিক্ষার্থীরা কাকরাইল মসজিদ মোড় ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করছেন। সেখানে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, জুলাই আন্দোলনে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম সেগুলোর মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদি হাসান হিমেল আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট আশ্বাস পাচ্ছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।