দেশের বাণিজ্য ও শিল্প খাতে সংকট কাটানো যাচ্ছে না। বিশেষ করে বেসরকারি শিল্প খাত ভালো নেই। প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গত আগস্টে সরকার পতনের পর থেকেই দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার, ডলার সংকট, এলসি জটিলতায় কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণে কমছে উৎপাদন। অনেক কারখানায় ঠিকমতো বেতন–ভাতা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ফলে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। এই অবস্থায় বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধিও কমছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত ডিসেম্বরে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়িয়েছে ৭.২৮ শতাংশ, যা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ সংকট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, টাকার অবমূল্যায়ন ও বিনিয়োগ মন্দাসহ নানা কারণে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা নেমেছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বেনামি–জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমে এসেছে। এর পাশাপাশি দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ও পর্ষদে পরিবর্তন হয়েছে এমন ১১টি ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এই ব্যাংকগুলো অবশ্য আমানতকারীদের টাকার চাহিদা মেটাতেই এখন হিমশিম খাচ্ছে। এ জন্য কমেছে প্রবৃদ্ধি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, দ্রুতই বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে এবং এই সমস্যার সমাধান হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশ হয়েছিল, দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৫৫ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে অর্জিত প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে নিচে রয়েছে। চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই–ডিসেম্বর) জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৯.৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।
বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংকগুলোর তারল্যের সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের পরিবেশ ছিল না। এ জন্য এই খাতের বিনিয়োগ কমেছে। তবে সরকারের স্থিতিশীলতায় এটি আবার বাড়বে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলেন, ঘুষ দুর্নীতি কিন্তু কমে নাই। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৩.৫ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগ সেটা জিডিপির এক শতাংশের নিচে ছিল। সেটা কমে কমে ০.৩ এর কাছাকাছি রয়েছে। একটা বড় সময় ধরে বাংলাদেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা কোনো সময়ই সারা পৃথিবীতেই কোনো জায়গায় বিনিয়োগ করতে চাইবে না যদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থাকে। এবং অনেকেরই আমাদের সাথে তো কথাবার্তা হয়, দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। তারা বলেছে যে ইলেকশনের আগে তারা নতুন বিনিয়োগ করার কথা ভাবছে না। এটা দুশ্চিন্তার কারণ। বিনিয়োগের মাধ্যমেই তো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে সিপিডির জরিপে ১৭টি সমস্যা সামনে এসেছে, এর মধ্যে দুর্নীতি এক নম্বর। ব্যবসায়ীরা বলতে পারছে না সরাসরি কারণ। ধরেন ব্যবসা যারা করেন, সেনসিটিভিটির মধ্যে থাকেন, তারা ভয়ের মধ্যে থাকেন যে কী বলতে কী বলে ফেলি। আবার ব্যবসার ক্ষতি হয় কিনা। আবার এখন তো দেখা যাচ্ছে আমরা অন্য ধরনের স্বাধীন অবস্থার মধ্যে রয়েছি যে কোনো একটা বক্তব্য পছন্দ হলো না, একটা মব জাস্টিসের মধ্যে পড়ে যায় অনেকে। তারা তো ওইরকম রিস্কের মধ্যে যেতে চায় না। যদি ভাঙচুর হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তাদের ব্যবসা তো বন্ধ হবে। পরিস্থিতি খারাপ হবে। ওখানে যারা কাজ করে তাদেরও।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান সংকট সমাধানে সময় লাগবে। কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচক খারাপের দিকে থাকায় ঢালাওভাবে কারখানা বন্ধ এবং শ্রমিকছাঁটাই যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। তাঁদের এই উদ্যোগ সফল হোক–সেই প্রত্যাশা আমাদের। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে, যেভাবেই হোক–বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে হবে।