কর্ণফুলী নদী রক্ষায় আদালত যে ভূমিকা গ্রহণ করছে, তা এক কথায় প্রশংসনীয়। দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের তালিকা চেয়েছে হাই কোর্ট। একইসঙ্গে এ নদীর দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের জায়গা জরিপ করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ ও পূর্ব পাশের জায়গা দখল করে মাটি ভরাট বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত। গত মঙ্গলবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লার বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। পরিকল্পনা সচিব, পরিবেশ সচিব, ভূমি সচিব, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। গত ১২ নভেম্বর পত্রিকায় ‘কর্ণফুলী দখল করে তৈরি হচ্ছে ড্রাই ডক’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ–এইচআরপিবি। অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, আদালত পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব ও দক্ষিণ পারে আনোয়ারা, পটিয়া, কর্ণফুলী ও বোয়ালখালী থানা এলাকায় নদীর মূল সীমানা সিএস/আরএস দাগ অনুসারে বিশেষ টিমের মাধ্যমে জরিপ করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার এবং দখলকারীদের তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে।
উল্লেখ্য, কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার ও কর্ণফুলী নদীকে বাঁচাতে ২০১০ সালে উচ্চ আদালতে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। এরপর আদালতের নির্দেশে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে জেলা প্রশাসন। ২০১৫ সালে তৎকালীন সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সামিউল মাসুদ প্রতিবেদনও জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কর্ণফুলীর তীরে মোট ১৫৮ দশমিক ৪৫ একর ভূমি অবৈধভাবে দখল করে স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ৫০ দশমিক ৬৪০০ একর সরকারি ভূমি নিয়ে মামলা আছে। বাকি ভূমি নিয়ে মামলা নেই। স্থানীয়ভাবে ১৫৮ একর ভূমির আনুমানিক মূল্য ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ওই প্রতিবেদনে ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, জনসাধারণের অসচেতন ও বেপরোয়া ব্যবহারে দিন দিন কর্ণফুলী নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। দখল ও ভরাটের করাল গ্রাসে এই নদীর মতো অনেক নদী মরে গেছে। নদী বাঁচলে জীবন বাঁচবে। নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই নদীকে বাঁচাতে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্ণফুলীতেই চট্টগ্রাম বন্দর। দেশে চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো বিকল্প বন্দর নেই। দখল–দূষণে কর্ণফুলী যদি গতিপথ হারায় তখন বন্দর বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কর্ণফুলী রক্ষায় সকল আয়োজন চট্টগ্রাম বন্দরকেই করতে হবে। অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকার পরও কর্ণফুলীতে ড্রেজিং করা হয়নি। দু’পাড় এখনো দখলমুক্ত করেনি। হাই কোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, নতুন করে গড়ে উঠছে অবৈধ স্থাপনা।
চট্টগ্রামের নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে কর্ণফুলীকে বাঁচানোর জন্য নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। তাঁদের দাবি, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে যেসব বেসরকারি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। খালগুলো দিয়ে যাতে গৃহস্থালি বর্জ্য, পলিথিন নদীতে পড়তে না পারে, বেলে মাটির পাহাড় বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাতে নদীতে পলি জমতে না পারে সে জন্য মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী সিলট্রেপ তৈরি করতে হবে। তাঁরা বলেন, নদী জীবন্ত সত্তা। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে যেমন চিকিৎসা দরকার তেমনি নদীরও শাসন, পরিচর্যা দরকার। কর্ণফুলী এখন মুমূর্ষু, বিপন্ন, অরক্ষিত। বড় সুনামি বা জলোচ্ছ্বাস হলে চট্টগ্রাম বন্দরসহ এ নগরকে চড়া মূল্য দিতে হবে। তাই জরিপ অনুযায়ী নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সেখানে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।