এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে গতবারের তুলনায় চট্টগ্রামে এবার গড় পাসের হার বেড়েছে। পাশাপাশি জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। গতবারের (২০২০ সালে) ৮৪.৭৫ শতাংশের স্থলে এবার গড় পাসের হার দাঁড়িয়েছে ৯১.১২ শতাংশ। যা গতবারের তুলনায় ৬.৩৭ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে গতবারের ৯ হাজার ৮ জনের স্থলে এবার জিপিএ-৫ প্রাপ্তের মোট সংখ্যা ১২ হাজার ৭৯১। গতবারের তুলনায় এ সংখ্যা ৩ হাজার ৭৮৩ জন বেশি।
জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কলেজে ভর্তির দুশ্চিন্তাও বেড়েছে সমানতালে। আগের মতোই ‘ভালো’ কলেজে ভর্তির টেনশন থেকেই যাচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মনে। অবশ্য, বরাবরের মতোই বেশি দুশ্চিন্তা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের ঘিরে। এর কারণও রয়েছে। প্রথম সারির কলেজগুলোতে বিজ্ঞানে অপ্রতুল আসন সংখ্যার বিপরীতে কয়েক গুণ বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর জিপিএ-৫ পাওয়ার কারণেই এ বিভাগে ভর্তিতে প্রতিযোগিতাটা বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবে দুশ্চিন্তাটাও বেশি। তবে অন্য দুই শাখায় (মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা) জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে অনেকটা নির্ভার বলা চলে। কারণ, মহানগরীর প্রথম সারির কলেজগুলোতে এই দুই শাখায় মোট আসন সংখ্যার তুলনায় কম সংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে থাকে। ফলে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভালো ফলধারী শিক্ষার্থীদের প্রথম সারির কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে তেমন বেগ পেতে হয় না বললেই চলে। প্রতিবারই এমনটি ঘটে আসছে। ব্যতিক্রম নয় এবারও। গত ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, এসএসসিতে এবার মোট জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা ১২ হাজার ৭৯১ জন। কিন্তু এর সিংহভাগই (১১ হাজার ২৯১ জন) বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। বাকি দুই শাখায় জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা দেড় হাজার (মানবিকে ১৫৬, ব্যবসায় শিক্ষায় ১৩৪৪)।
অন্যদিকে, মহানগরের প্রথম সারির কলেজগুলোতে এ বছর বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা ৩ হাজার ২৮৫টি। বিজ্ঞান শাখায় আসনের তুলনায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন গুণেরও বেশি হওয়ায় ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। ২০১৫ সালে বিজ্ঞানে আসন সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৩০। কিন্তু ২০১৬ সালে মহানগরে নতুন করে একটি সরকারি কলেজ (বাকলিয়া সরকারি কলেজ) যুক্ত হয়। পাশাপাশি সরকারি মহিলা কলেজে ১৫০ আসনের নতুন একটি সেকশন খোলায় বিজ্ঞানে আসন বাড়ে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে আরো একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে (চট্টগ্রাম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ) সরকারি করা হয়। এতে করে মহানগরে সরকারি কলেজের সংখ্যা আরো একটি বেড়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে সরকারি কলেজগুলোতে পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু আসন বাড়ানো হয়েছে।
মহানগরের সরকারি কলেজগুলোতে সব মিলিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে বর্তমানে আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৮৫টি। তবে মহানগরীর প্রথম সারির কলেজগুলোতে বিজ্ঞানে আসনের তুলনায় এই বিভাগে জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বরাবরই কয়েক গুণ বেশি থাকে। ব্যতিক্রম নয় এবারও।
এবার বিজ্ঞানে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ ধারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১ হাজার ২৯১। কিন্তু মহানগরের সরকারি কলেজগুলোতে বিজ্ঞানে ঠাঁই হবে ৩ হাজার ২৮৫ জন শিক্ষার্থীর। অর্থাৎ বিজ্ঞানে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা নগরীর সরকারি কলেজগুলোতে বিজ্ঞানের মোট আসনের তিন গুণেরও বেশি। হিসেবে বিভাগটির জিপিএ-৫ পাওয়া আরো ৮ হাজার ৬ শিক্ষার্থী প্রথম সারির কলেজ হিসেবে পরিচিত নগরীর সরকারি কলেজগুলোর বিজ্ঞান শাখায় ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
অথচ, অন্য জিপিএধারীদের কথা বাদ দিলেও জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সবার লক্ষ্য থাকে চট্টগ্রাম মহানগরের প্রথম সারির সরকারি কলেজগুলো। কিন্তু এসব কলেজে অপ্রতুল আসনের কারণে শহরের সিটি কর্পোরেশনভুক্ত কিংবা বেসরকারি কোনো কলেজে (এমপিওভুক্ত, আংশিক এমপিওভুক্ত অথবা এমপিও বহির্ভূত), নয়তো নগরীর বাইরে কোনো সরকারি কলেজে ঠিকানা খুঁজে নিতে হবে এই বিশাল সংখ্যক জিপিএ-৫ ধারীকে।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর জাহেদুল হক বলেন, মহানগরের সরকারি কলেজগুলোর মোট আসন সংখ্যার তুলনায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সর্বোচ্চ জিপিএপ্রাপ্ত সব শিক্ষার্থী তাদের প্রত্যাশিত কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে না। এক্ষেত্রে তাদের বেসরকারি কোনো কলেজ (এমপিওভুক্ত বা সিটি কর্পোরেশনের অধিভুক্ত) বেছে নিতে হবে। নয়তো শহরের বাইরে সরকারি কোনো কলেজ খুঁজে নিতে হবে।
এদিকে, গতবারের তুলনায় বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করেছে এবার। এসএসসিতে গতবার মোট পাস করে ১ লাখ ২১ হাজার ৮৮৮ জন। এবার পাস করেছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫০ জন। গতবারের তুলনায় ২২ হাজার ৬৬২ জন বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছে এবার। গতবারের তুলনায় বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী পাস করলেও সামগ্রিকভাবে আসন সংকট হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর জাহেদুল হক। তিনি বলেন, বোর্ড অনুমোদিত চট্টগ্রামে ২৭৮টি কলেজে এবার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। সব মিলিয়ে বোর্ডের অধীন কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার। আর এবার এসএসসি পাস করেছে মোট ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫০ জন, যা মোট আসন সংখ্যার তুলনায় কম। তবে মাদ্রাসা ও কারিগরির অনেক শিক্ষার্থী প্রতি বছর কলেজে ভর্তি হয়। এরপরও সামগ্রিকভাবে আসন সংকট হবে না। সব শিক্ষার্থীই কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে।
শিক্ষাবোর্ডের কলেজ শাখার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরে ৮টি সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এগুলো হলো চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ, বাকলিয়া সরকারি কলেজ, সরকারি কমার্স কলেজ, কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং চট্টগ্রাম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এই কলেজগুলোতে তিন বিভাগে (বিজ্ঞান, ব্যবসায় ও মানবিক) মোট আসন সংখ্যা ৯ হাজার ৩০০টি। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে মোট আসন রয়েছে ৩ হাজার ২৮৫টি, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৩ হাজার ৫৬০টি এবং মানবিক বিভাগে ২ হাজার ৪৫৫টি আসন রয়েছে।
শিক্ষাবোর্ডের কলেজ শাখা সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ৬৫০টি, মানবিক শাখায় ৩৮০টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে এবার। সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ৬৫০টি, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৬১৫টি এবং মানবিক শাখায় ৪৬০টি আসন রয়েছে। সরকারি সিটি কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ৬৫০ আসনে, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৭৬০ আসনে (দিবা ও বৈকালিক ৩৮০ করে) এবং মানবিক বিভাগে ৭১০ আসনে (দিবায় ৩৮০, বৈকালিকে ৩৩০) শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। ব্যবসায় শিক্ষা শাখার বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত সরকারি কমার্স কলেজে ৮৫০ জন শিক্ষার্থী কলেজটির ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ভর্তির সুযোগ পাবে।
চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ৪৯০ আসনে, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৪৭০ আসনে এবং মানবিক শাখায় ৩৭৫টি আসনে ছাত্রী ভর্তির সুযোগ পাবে এবার। বাকলিয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান ও মানবিক শাখায় ৩৮০টি করে এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ৫২৫টি আসন রয়েছে। বিজ্ঞান শাখায় আরো একশ আসন বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছে কলেজটি। সেটি অনুমোদন পেলে কলেজটির বিজ্ঞান শাখায় আরো একশ শিক্ষার্থী বেশি ভর্তির সুযোগ পাবে।
সরকারি কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির এ দুটি শাখায় ৯০ জন করে মোট ১৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে এবার। এছাড়া সমপ্রতি সরকারিকরণকৃত চট্টগ্রাম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণিতে মোট ৭৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে। এর মধ্যে বিজ্ঞানে ৩৭৫ জন, ব্যবসায় শিক্ষায় ২৫০ জন এবং মানবিক বিভাগে ১৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে।
সব মিলিয়ে মহানগরীর ৮টি সরকারি কলেজে মোট ৯ হাজার ৩০০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে এবার। এর মধ্যে বিজ্ঞান শাখায় ৩ হাজার ২৮৫, মানবিক শাখায় ২ হাজার ৪৫৫ এবং ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ৩ হাজার ৫৬০ আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে।