আষাঢ়ের দাবদাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত। খাল বিল পুকুর নদে হাঁটু পানি। ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। কি ভাবছেন পাঠক? চৈত্র কিংবা বৈশাখ লিখতে গিয়ে ভুল করে আষাঢ় লিখে ফেলিনিতো? না আষাঢ়ের কথাই বলছি, আষাঢ়ে গল্প নয়। আষাঢ় শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। ছেলেবেলায় পড়া ঋতু বৈচিত্র্যে বর্ষার নাম এলেই টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টির শব্দ কানে বেজে ওঠে। কবিগুরুর ‘এসো নীপবনে… কিংবা নজরুলের ‘শাওন রাতে যদি’–র মতো অসংখ্য গান–কবিতা রচিত হয়েছে বাংলার বর্ষাকে ঘিরে। তীব্র দহনের কাল পেরিয়ে অনাবিল শান্তির পরশ বুলিয়ে যায় আষাঢ়। নতুন সাজ নেয় প্রকৃতি।
হায় বর্ষা! এই বর্ষার আকাশ থেকে হারিয়ে গিয়েছে বারিধারা। নগরের সুশীল আর সংস্কৃতিমনা নাগরিকগণ অবশ্য বর্ষা নামিয়ে ফেলেন আলোকিত মঞ্চে। ছুটির সন্ধ্যায় উদযাপিত হয় বর্ষা উৎসব, বৃষ্টি ও বজ্রপাতের কৃত্রিম শব্দ, শ্বেতশুভ্র নয়তো নীলাম্বরী পোশাকে সুবেশী নর–নারী সংগীতের মূর্চ্ছনায়, নৃত্যের তালে তালে মেতে উঠে বর্ষাবন্দনায়। উৎসব শেষে ভূরিভোজন চলে খিচুড়ি, ইলিশ, বেগুন ভাজাসহ হরেক রকমের ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন আর ফল ফলাদি সহকারে।
আষাঢ় পেরিয়ে বর্ষপঞ্জী শ্রাবণে প্রবশ করেছে। বাদল দিনের জন্য তুলে রাখা শাড়িগুলোতে আজও হাত দেওয়া হয়নি। গেল বছরও বাক্সবন্দী হয়ে পড়েছিল ওরা। আগুন ঝরা এক শ্রাবণের পড়ন্ত দুপুরে বাড়ি ফিরে ভাবছিলাম– এমনি করেই কি বিদায় নেবে ষড়ঋতুর দেশের বর্ষাকাল? অভিশপ্ত নগরীতে কি তবে আর বৃষ্টি নামবে না! বৈশ্বিক উষ্ণতার যুগ শেষে পৃথিবী এখন ফুটন্ত যুগে প্রবেশ করেছে– জাতিসংঘের মহাসচিব এমনই অভিমত ব্যক্ত করেছেন কয়েকদিন আগে। তাঁর অবশ্য ভারি ভারি কথা বলা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই, অনেকটা আমাদের দেশের জননেতাদের মতো। পরিবেশ সম্মেলনে বিশ্বমোড়লদের কার্বণ নিঃসরণ কমাতে একমত করাতে পারেননি তিনি। যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেননি পরাশক্তিদের। ফিলিস্তিন থেকে মায়ানমার, আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ এশিয়া–শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন সর্বত্র। বলকান অঞ্চলে যুদ্ধ বছর গড়িয়ে দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করার পথে। সহসা থামবে বলে মনে হয় না। তবুও মহাসচিব মহোদয় পদ আঁকড়ে বসে আছেন আর ভাষণ শুনিয়ে চলেছেন।
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী আর বন্দর শহর চট্টগ্রামে শ্রাবণেও আগুন ঝরে– তার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবকে দায়ী করা সঙ্গত নয় হয়তোবা। কিন্তু তিনি যে ফুটন্ত যুগের কথা বলছেন, তার একটা প্রভাবতো সব দেশেই পড়তে পারে– এ নিয়ে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টি নামে। তবে এক পশলা। পথ ঘাট ভেজেনা। বৃষ্টি বোধ হয় ভয়ই পেয়েছে। অনেক প্রতীক্ষার পর শ্রাবণের তৃতীয় সপ্তাহে পা দিয়ে নগরী প্রত্যক্ষ করে বর্ষার আসল রূপ। কবির কথাই যেন সত্য হয়ে ধরা দেয়– ‘ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে… । কি অবাক কাণ্ড! খবরের কাগজ খুলে দেখি– সেদিনই বাইশে শ্রাবণ। কবিগুরুর প্রয়াণ দিবস।
ভাগ্যিস গুরুদেব এই শহরে আসেননি। যদি আসতেন, দেখতেন কী বেহাল দশা আমাদের। তিনি যে পালিয়ে বাঁচতেন তাই না, গান কবিতাও বোধ করি পালাত তাঁর কলম হতে। এক ঘণ্টার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা আর জনদুর্ভোগ, নাগরিক রাস্তায় বন্যার ঢল, দোকানঘরে হাঁটু পানি, নির্মাণাধীন পরিত্যক্ত দালানের আশপাশ সয়লাব। নগর জুড়ে আবর্জনার পাহাড় সরতে দেয়না পানিকে। বলতে বাধা নেই, আমাদের মতো আধুনিক মানুষদেরই গৃহস্থালি বর্জ্য; আমরাই ফেলে রাখি যত্রতত্র। নগর পিতাগণ নির্বিকার, কখনওবা অতিমাত্রায় সরব। আকাশছোঁয়া ব্যানার পোস্টারে সচেতনতামূলক অমর বাণী ছাপিয়ে সেই সঙ্গে বিশালাকৃতির হাস্যোজ্বল প্রতিকৃতি জুড়ে দিয়ে রাজকীয় দায়িত্ব পালন করে যান তাঁরা জাতির দুর্যোগ মুহূর্তে।
শহর থৈ থৈ করে। সড়ক উপচে পড়া ঘোলা পানিতে হৈ হৈ করে জাল নিয়ে মাছ শিকারে নামে নগরবাসী। এমনই তামশাপ্রিয় জাতি আমরা! কোনো কিছুই আমাদের স্পর্শ কওে না, কচু পাতার মতো আমরাও গা ভেজাই না; মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলতে পারি সকল দুর্ভোগের চিহ্ন। কাগজে দেখলাম, প্রাচ্যের রাণী তিলোত্তমা নগরী চলতি বছরে সাত মাসে দশ বার ডুবেছে। এটা এক মাসের আগের খবর। গেল এক মাসে আরও অন্তত দু’বার ডুবেছে বীর চট্টলা। সপ্তাহখানেক বাদে বৃষ্টি বিরতি নিলেও রেখে গিয়েছে ক্ষতচিহ্ন। সড়কের ছালচামড়া উঠে গিয়ে উঁকি মারছে ভয়াল দর্শন কঙ্কাল। রাজপথ জুড়ে ছোট বড় গর্ত, কোথাওবা পুকুর ডোবা বলে ভ্রম হয়। জনপ্রতিনিধিগণের এসব পথ তেমন একটা মাড়াতে হয় না। কালেভদ্রে যদিওবা দু’এক জন এসে পড়েন, কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ঝলমলে রাজকীয় বাহনে বসে এই ক্ষতবিক্ষত সড়কের ফোড়ন তাঁরা টের পান না। রঙিন কাঁচের ওপাশ হতে শহরের হট্টগোল, দাবদাহ ও দুর্গন্ধ তাঁদের স্পর্শই করে না।
বর্ষপঞ্জী থেকে খসে পড়ে আরেকটি পাতা। শ্রাবণ শেষে আসে ভাদ্র। তালপাকা গরম আসি আসি করেও আসতে পারছে না। আষাঢ়ের বকেয়া বারিধারা বোধ করি ভাদ্রে এসে ঝরবে বলে পণ করেছে। মন্দ নয়। ভ্যাপসা গরমের হাত থেকে তো নিষ্কৃতি মিলছে। বিদ্যুৎ নেই বলে পাখা না ঘুরলেও ঘরে বাইরে কাজ করা যায়, স্বস্তিতে ঘুমোনো যায়। এইটুকুতেই কিন্তু চলে যায় নগরবাসীর। কিন্তু এক শাওন রাতে আবারও শহর ডোবে, সেই বাইশে শ্রাবণের মতো করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য সেদিন ছিল বারোই ভাদ্র। ফুলের জলসায় নীরব কবি নজরুল এমনই এক দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সশরীরে।
বাংলার বর্ষা বন্দনায় রবি–নজরুলের কাছে হাত পাতা ছাড়া বাঙালির সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। সুজলা–সুফলা শস্য–শ্যামলা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে মৌসুমি বৃষ্টি। কিন্তু বৃষ্টি যখন শহরটাকে ধুয়ে মুছে সাফ না করে দিয়ে জলাবদ্ধতা ও আবর্জনায় পুঁতিগন্ধময় করে তোলে, দুর্বিষহ করে তোলে নাগরিক জীবন, তখন একে আর আশীর্বাদ বলা চলে না। নর্দমা ঘিরে বসত গড়া বস্তিবাসীর কথা নাই বা বলি। পোকা মাকড়ের জীবন পাওয়া এই জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবন আমাদের নাগরিক আলোচনায় স্থান পায় না বললেই চলে। যদিও নির্বাচনের মৌসুম এলে তাঁদের এঁদোগলিতে সুখি সুখি চেহারার ভদ্রলোকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। কিন্তু শহরের প্রাণকেন্দ্রে আধুনিক ও উন্নত জীবন যাপনের উপযোগী সকল উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত আবাসিক এলাকাগুলোতেও যখন রান্নার চুলাকে খাটের ওপর আশ্রয় নিতে হয়, বিছানা বালিশের সঙ্গে সঙ্গে ভিজে চুপচুপে হয়ে যায় ছেলেমেয়েদের বই খাতা তখন কি জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়নের বয়ান বড়ই বেসুরো লাগে না? নজরুলের সেই অমোঘ বাণী আমরা যে ভুলেই বসেছি–
তুমি শুয়ে রবে তেতলার পরে আমরা রহিব নিচে
অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে ভরসা আজ মিছে।
অপশক্তির কাছে মাথা নোয়াতে গিয়ে আমাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে বসেছে। কেবলমাত্র নিজের পিঠ বাঁচিয়ে আর পেট ভরিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই আমরা। ভাবতে অবাক লাগে, ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম নগরগুলোর একটি এই চট্টগ্রাম নিয়ে সেই আদিকাল থেকেই উৎসাহের সীমা ছিল না ভাগ্যাণ্বেষী বণিকদের। ইউরোপ, আফ্রিকা ও আরবদেশ হতে কত ভবঘুরে খালি হাতে এসে এই শহরে চড়িয়ে– বেড়িয়ে জাহাজ বোঝাই করে ফিরে গিয়েছে স্বদেশে! আজও ওঁত পেতে আছে বিদেশি প্রভু। আরও আছে স্বদেশী টাকার কুমির। আট মাসে বারো বার ডোবা এই শহর নিয়ে নিয়ে আজও চলছে মহাপরিকল্পনা, সহস্র কোটি টাকার প্রকল্প। আজকের কাগজেই এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার ‘হাব’ হবে এই শহর। অতঃপর আবারও আকাশে বাতাসে টাকা ওড়ে। বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমিতে বছর জুড়েই চলতে থাকে জনদুর্ভোগ আর নাভিশ্বাস।