ময়ুখ চৌধুরী–এই নামটা উচ্চারিত হতেই এখন হৃদয়ের গভীরে কেমন যেন এক মায়াময় শ্রদ্ধা–ভালবাসা–ক্ষোভ–অভিমানের ঝড়ো বাতাস বয়ে যায়। শ্রদ্ধা–ভালবাসা আর ক্ষোভ–অভিমান এই দুটি শব্দযুগল সাংঘর্ষিক। প্রায় তিন যুগের লালিত অনুভূতির এই বৈপরীত্যের ব্যাখ্যায় যাবো না। কারণ ক্ষোভ–অভিমানের কারণ আবিষ্কার করতে গেলেও ফলাফল হবে–প্রচণ্ড ভালবাসা। এই ভালবাসা নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ। ব্যক্তি ময়ুখ চৌধুরীকে যতটা না ভালবাসি তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসি তাঁর কবিতাকে, তাঁর গদ্যকে, তাঁর অধীত বিষয়ের বাচনিক উপস্থাপনকে।
ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার সাথে আমার প্রায় ৪০ বছরের পরিপক্ক সংযোগ। তাঁর কবিতার আবৃত্তিক ও শৈল্পিক চর্চা ও পরিবেশনায় আমি এবং আমার আবৃত্তি সংগঠন পথিকৃতের দাবি করতে পারে। ময়ুখ চৌধুরীর বহুলপঠিত ও জনপ্রিয় কবিতা ‘আগুন আগুন’ ‘জন্মরাতে’ ‘ভালবাসার প্রথম অধিবেশন’ সাত মাত্রার স্বরবৃত্তের ‘এ শহর আমার শহর’ ইত্যাদি কবিতা আমার মাধ্যমে প্রথম আবৃত্তি–নির্মাণ হয়ে একক ও দলগতভাবে পরিবেশিত হয়। একটা ব্যাপার গভীরভাবে লক্ষ করেছি, আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান কবি, আমারও ভীষণ প্রিয় কবি আল মাহমুদকে এক শ্রেণির কাব্যমোদী ও সমালোচকরা যেভাবে ‘সোনালী কাবিনের কবি’ বলে সীমাবদ্ধ রাখার অপপ্রয়াস চালায়, চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক মূল্যায়ন করে, ঠিক একই প্রক্রিয়া ও অপতৎপরতায় ঈর্ষা–আক্রান্ত অসুস্থজনরা ময়ুখ চৌধুরীকে ‘কালো বরফের প্রতিবেশী’ কাব্যগ্রন্থের কবি বলে বন্ধনীযুক্ত করতে চায়। কিন্তু তবুও কবিতা না–পড়া ও না–বোঝার ব্যর্থতা ও অজ্ঞতাকে স্বীকার করতে চায় না। ‘কালো বরফের প্রতিবেশী’ কাব্যগ্রন্থের পর ‘অর্ধেক রয়েছি জলে,অর্ধেক জালে’, ‘তোমার জানালায় জেগে আছি চন্দ্রমল্লিকা’, ‘পলাতক পেন্ডুলাম’, ‘ক্যাঙ্গারুর বুকপকেট’, ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডহিন’, ‘অনিদ্রার কারুকাজ’ ইত্যাদি গ্রন্থে শতাধিক কবিতা আছে যা কালের বিচারে সাহিত্যের গবেষকদের গবেষণার বিষয় এবং উদ্ধৃতিযোগ্য কবিতা হিসাবে গ্রন্থের পাতায় পাতায় স্থান পাবে। সাহিত্যের একজন পাঠক হিসাবে, কবিতা–পড়া এবং বোধে–মননে–চর্চায় কবিতাকে ধারণ–করা একজন আবৃত্তিশিল্পী হিসাবে এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। ময়ুখ চৌধুরীকে নিছক আপাদমস্তক রোমান্টিক কবি আখ্যা দেয়ার একটা বয়ান শোনা যায়। যা সঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, ময়ুখ চৌধুরী যখন লিখেন আর আমরা আবৃত্তি শিল্পীরা যখন কবির অনুভূতির অনুগামী হয়ে আবৃত্তি করি-‘ভালবাসা মরে/তবু,পিছুটান কখনো মরেনা’ অথবা ‘একমাত্র তুমিই দেখতে পেলে/তোমার শিক্ষিত চোখে/আমার বুকের পাড়ায় কী–জবর লেগেছে আগুন’। তখন আমাদের বুকের পাড়ায়ও একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। হয়তোবা অনেকের বুকে জমে থাকা কষ্টগুলো বমির মত বেরিয়ে আসতে চায়। কবি যখন আরও লিখেন ‘মাঝে মাঝে দূরে যাওয়া ভাল/দূরে গেলে মনে হয় কেউ কাছে ছিল/কাছে এলে দহনের জ্বালা/দূরে গেলে আলো’। এসব পড়তে পড়তেই মনে হয় এ যেন অনেকেরই প্রাণের কথা, অনেকেরই মনের ব্যথা। আবার যখন লিখেন ‘তুমি জলের আর্দ্রতাতে পাতার সবুজতায়, যদিও তুমি এতই কাছে তবুও তুমি কোথায়’। তাঁর এমন অজস্র উজ্জ্বল পঙ্ক্তি আছে যা অনেক তরুণ–তরুণীর হৃদয়কে ঘায়েল করবে। এগুলো পথ চলতে চলতে অযত্ন অবহেলায় সিগারেটের প্যাকেটে, বাজারের স্লিপে লেখা পদাবলী। যার অনেকগুলোই দুই মলাটে বন্দী হয় নি। আমার মত কারো কারো কাছে কবিতাগুলো ছিন্নভিন্ন জীর্ণ কাগজে তাঁর হাতের লেখায় ঘুমোচ্ছে। কিন্তু এগুলোই ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যশক্তির ইনডিকেটর নয়। তিনি আরও গভীর থেকে গভীরতর উপলব্ধির অনেক কবিতা লিখেছেন। আবার কেউ কেউ কবিতায় দর্শন খুঁজতে যান। আমি তাদের সাথে সহমত নই। আমি কবিতা পড়তে পড়তে বুঝেছি, কবিতা আরোপিত কিছুর ভার সয়না। কবিতা দর্শনের ভারে ভারাক্রান্ত হলে সেটি আর কবিতা থাকে না। আর কবিতাতে যদি দর্শনের সন্ধানেই থাকি তাহলে কবিতা পড়বো কেন। ইমাম গাজ্জালি, মিশেল ফুকো, জ্যাক দেরিদা, কিয়ের্কেকার্ড পড়বো। যাহোক ময়ুখ চৌধুরীর কবিতায় আসি। ‘এ শহর আমার শহর’ কবিতায় তিনি কেবল ছন্দের কারিশমা দেখান নি, চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গগুলোকে অত্যন্ত কাব্যময়তায় বিবৃত করেছেন। বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশের অনেক কবি–লেখকের মত কবি ময়ুখ চৌধুরীও ভয়ের সংস্কৃতি থেকে ভীতিমুক্ত ছিলেন না। তবুও তিনি লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ ফিরে এসো, আর একবার মুক্তিযুদ্ধ করো/পরিকীর্ণ আকুল বিশ্বাসে/পরিপূর্ণ মুক্তির নিশ্বাসে’। তিনি আরো লিখেছেন ‘প্রতীকে প্রতীকে আজ চলে মানুষের বেচাকেনা,/নূর হোসেন, সংসদে যাবে না?’ ২৫/৩০ বছর আগের কবিতা। কত আগে তিনি মুক্তির সন্ধান করেছেন, পরিপূর্ণ মুক্তির জন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন, কত আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় তারুণ্যের হিস্যা চেয়েছেন! একটি নিরাপদ বর্তমানের জন্য কবির অতীতের এই আকুতি তাঁর দেশাত্মবোধ ও দৈশিক চেতনার জানান দেয়। ময়ুখ চৌধুরী আমাদের দেশের সত্তর দশকের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ কবির একজন। বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জেলাতে এবং কোলকাতায় আবৃত্তি করার সুবাদে কবিতা প্রেমিকদের সাথে কথা বলে বুঝতে পেরেছি চট্টগ্রামে অবস্থানরত কবিদের মধ্যে তারা ময়ুখ চৌধুরীকে অনেক বেশি চেনেন। তাঁর কবিতা পছন্দ করেন। আমাদের দেশের বহুল প্রচারিত পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলোতে ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা ও গদ্য যত্নের সাথে ছাপা হয়। ঢাকার এবং ঢাকা–কোলকাতার যৌথ সম্পাদিত কবিতা সংকলনগুলোতে ময়ুখ চৌধুরী অনিবার্যভাবে স্থান পেয়েছেন।এই সবকিছুই তাঁর সৃজনকর্মের খ্যাতি ও বিশিষ্টতা অর্জনের স্মারক। কবিতার জন্য বারবার তাঁর নামটি উচ্চারিত হবার পরও বাংলা একাডেমি পুরস্কার বা একুশে পদক না পাওয়ায় ময়ুখ চৌধুরীর এই অর্জন একটুও বিঘ্নিত হয় নি।
আবৃত্তি শিল্পীদের জন্য ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা মানে এক অন্যরকম অনুভূতি। নব্বই দশকে ময়ুখ চৌধুরীর চট্টগ্রামের দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সম্ভবত চট্টগ্রাম শহরের পাঁচ ছয়জন সৌভাগ্যবান লেখক–শিল্পীর আমি একজন যার ৩২, দক্ষিণ নালাপাড়ার ওই স্বাপ্নিক ও কাঙ্ক্িষত বাসায় যাবার অবাধ অধিকার ছিল। আমি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতার একজন বোদ্ধা ও মুগ্ধ পাঠক এই কথাটা কবি নিজে অকপটে আনন্দের সাথে অনেককেই বলতেন। একজন আবৃত্তিশিল্পী হিসাবে তাই আমি একটা সুযোগ বারবার নিতাম। আর তা হলো আমি যখন ময়ুখ চৌধুরীর কোন কবিতার আবৃত্তি–নির্মাণ করবো ঠিক করতাম তখন ওই কবিতাটি তাঁর কন্ঠে শুনতে চাইতাম। কবিকন্ঠে এই পাঠ আমার আবৃত্তি–নির্মাণে কী যে কাজে লাগতো, তা বর্ণনাতীত। গান যেমন সুরাশ্রয়ী হয়ে বাণীকে তুলে ধরে, নাটক যেমন অভিনয় গুণে চরিত্রকে বাস্তবানুগ করে ফুটিয়ে তোলে, তেমনি আবৃত্তিকার আবৃত্তি গুণে শ্রোতাদের কবির কল্পনাশ্রয়ী জগতে পৌঁছে দেয়। কবিতার শরীরে, স্তবকে স্তবকে, চরণে–চরণে, পঙ্ক্তিতে–পঙ্ক্তিতে নানাবিধ অনুভূতির যে বিন্যাস থাকে, একজন আবৃত্তিকার বোধের গভীরতায় তাকে হৃদয়ে ধারণ করে। কবির অনুভূতি থেকে রচিত পঙ্ক্তিমালা আবৃত্তি শিল্পীর হৃদয়বোধে সিক্ত হয়ে কন্ঠে উচ্চারিত হয়। আবৃত্তিকাররা কবির বাণী ও অনুভূতির প্রচারক নন। কবিতার অনুবাদকও নন। আবৃত্তি শিল্পীদের শতভাগ সৃজনশীল ভূমিকাও রয়েছে। আর সে কারণেই আবৃত্তিকার একজন শিল্পী। যাহোক, ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা পড়া শেষ হলে আবার কবির যাদুময় অনর্গল কথা বলা তন্ময় হয়ে শুনতাম। কবিতা, গান, সিনেমা ইত্যাদি বিষয়ে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, আর বাকপটুতা সবকিছু থেকে একজন একান্ত অনুগত ছাত্রের মত শেখার চেষ্টা করতাম।
কমপক্ষে ত্রিশ বছর ‘স্যার’ ডেকে চলেছি। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক নন। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু তিনি প্রকৃত অর্থেই আমার স্যার। আমার শিক্ষক। আমি তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। শুধু আমি কেন, চট্টগ্রাম শহরের অনেক লেখকই স্যারের ড্রইংরুমে বসে কাগজে–কলমে শিখেছেন, গ্রহণ করেছেন। অত্যন্ত দৃঢ়তা ও কৃতজ্ঞতার সাথে বলছি, আমি স্যারের ৩২, দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসার ড্রইংরুমের অনেক বছরের ছাত্র।
 
        
