বিকেল সাড়ে চারটার কম বেশি হবে। জীর্ণ–শীর্ণ এক গলির ভেতরের একটি মুদি দোকানের গোডাউনে যা হচ্ছিল তা কল্পনাই করা যায় না। গোডাউনে সারিসারি পেঁয়াজের বস্তার উপরে পড়ে আছে রক্তাক্ত একটি দেহ। বয়স কত হবে! মাত্র সাত বছর। প্রথম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। চোখ বেয়ে পড়া পানির চাপ ছিল মুখমন্ডলে। পাশেই দণ্ডায়মান এক ব্যক্তি। সুস্থ মস্তিস্কের সেই লোক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, কী করা যায় তা ভেবে। একটু আগেই তো তিনি একজন অবুঝ, ক খ গ শিখছে এমন শিশুর সাথে যৌন কামনা চরিতার্থ করেছেন। কান্না পাচ্ছিল, কষ্ট হচ্ছিল, রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, চিৎকার তো করবেই। লক্ষণ দাশ তা মেনে নেননি। ডান হাতে নাক–মুখ এবং বাম হাতে দুই হাত চেপে ধরে। একটা সময় শ্বাস প্রশ্বাস থেমে যায় শিশু বর্ষার। দুনিয়ায় এসে শুধু হাঁটাচলা শিখেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে বুঝতে পেরে একটি সাদা বস্তায় বর্ষার লাশ ঢুকানো হয়। যে ১০০ টাকার লোভ দেখিয়ে গোডাউন পর্যন্ত শিশু বর্ষাকে ডেকে নিয়েছিল সেই ১০০ টাকার নোটটিও সেই রক্তে লাল হয়েছিল। চতুর মুদি দোকান কর্মচারী লক্ষণ দাশ সেই ১০০ টাকার নোটটিও বস্তায় ঢুকিয়ে নেন। বস্তার ভেতর বর্ষার কাপড়ও তিনি ভরেন। গিট দেওয়ার পর পাশের নালায় বস্তাটি ফেলে দেন। এরপর ফিরে আসেন গোডাউনে। দেখতে পান– পেঁয়াজের বস্তার পাশেই পড়ে রয়েছে বর্ষার জুতা জোড়া। এটাতো প্রমাণ। প্রমাণ রাখা যাবে না। কোনো চিহ্নও রাখা যাবে না। এসব ভেবে লক্ষণ দাশ জুতা জোড়াও নিয়ে গিয়ে নিক্ষেপ করেন নালায়। নগরীর জামালখানের শিকদার হোটেল এলাকার আলোচিত সেই শিশু বর্ষাকে ধর্ষণ, শ্বাসরোধ করে খুন ও লাশ গুমের চেষ্টার মামলায় আদালতে সম্প্রতি চার্জশিট দাখিল করেছে তদন্ত কর্মকর্তা। স্বাভাবিকভাবেই লক্ষণ দাশকে এতে অভিযুক্ত করা হয়েছে। শিকদার হোটেলের পাশের শ্যামল স্টোরের কর্মচারী ছিল লক্ষণ দাশ। এ স্টোরের গোডাউনেই শিশু বর্ষাকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন তিনি। চিপসসহ নানা কিছু কেনার জন্য শ্যামল স্টোরে প্রায়ই যেতেন বর্ষা। এ কারণে সে লক্ষণকে চিনতো। ঘটনার দিন ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর গোডাউনের সামনে দাড়িয়ে ছিল লক্ষণ। তখন বর্ষা সম্ভবত দোকানের দিকেই যাচ্ছিল। লক্ষণ তাকে বলে যে, চিপস কিনতে ১০০ টাকার জন্য গোডাউনে আসো। পূর্ব পরিচিতির কারণে বর্ষা তার পিছু পিছু সেদিন গোডাউনে গিয়েছিল। গোডাউন পর্যন্ত আসার আগেই বর্ষার হাতে কথা মতো ১০০ টাকার একটি নোট দেন লক্ষণ। যা পরে রক্তাক্তও হয়। বর্ষাকে যে বস্তায় ভরা হয়েছিল সেটিতে রক্তাক্ত সেই ১০০ টাকার নোটটিও ভরে নালায় ফেলেছিলেন লক্ষণ। তদন্ত কর্মকর্তার দেওয়া চার্জশিটেই এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়।
আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার তিনদিন পর শিকদার হোটেলের পাশের নালা থেকে বস্তাবন্দি শিশু বর্ষার লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ তদন্তে নামে। নানা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে। একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়। সেই ফুটেজেই ধরা পড়ে যায় লক্ষণ দাশ। পরে তাকে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতে প্রেরণ করা হলে তিনি বর্ষাকে ধর্ষণের কথা, শ্বাসরোধ করে হত্যা করা এমনকি বস্তায় ভরে লাশ নালায় ফেলার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এদিকে আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, ডিএনএ রিপোর্টে শিশু বর্ষাকে ধর্ষণের আলামত মেলেনি। তবে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, আদালতে দেওয়া আসামির জবানবন্দিতে বর্ষাকে ধর্ষণ, শ্বাসরোধ করে হত্যা ও লাশ গুমের চেষ্টার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনার পর বর্ষার মা ঝর্ণা বেগম বাদী হয়ে একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলেন। পরে লাশ উদ্ধারের পর তিনি নগরীর কোতোয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। তার আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান দৈনিক আজাদীকে বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা ও কোতোয়ালী থানার এসআই নওশের কোরেশী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর লক্ষণ দাশের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। সেখান থেকে তা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। সেখানেই মামলাটির বিচারকার্য চলবে। চার্জশিট গ্রহণ বিষয়ে শুনানি হবে প্রথমে। এজন্য আদালত একটি তারিখ নির্ধারণ করবে। ডিএনএ’তে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি বিষয়ে কোনো আপত্তি আছে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নথিপত্র বিচার–বিশ্লেষণ করব। চার্জশিট দাখিলের বিষয়টি আজকেই (গতকাল) জেনেছি আমরা। সেইক্ষেত্রে একটু সময় লাগবে। তিনি বলেন, ডিএনএ রিপোর্ট দাখিলে অনেক টালবাহানা হয়েছিল। এ ডিএনএ রিপোর্টের কারণে চার্জশিট দাখিলে বিলম্ব হচ্ছিল। আমরা আদালতকে বিষয়টি অবহিত করেছিলাম। আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে ময়নাতদন্ত সম্পন্নকারী ফরেনসিক চিকিৎসকের কাছে এ বিষয়ে জেনে জানানোর জন্য গত জুলাইয়ের ২৩ জুলাই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর ডিএনএ রিপোর্ট দাখিল করা হয়। আসামিকে সুবিধা দিতে ডিএনএ রিপোর্ট কারসাজি কী না সেটিও দেখার বিষয় জানিয়ে সিনিয়র এ আইনজীবী বলেন, লোমহর্ষক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন লক্ষণ দাশ। ধর্ষণ, খুন, লাশ গুমের চেষ্টা সবকিছু চতুরতার সাথেই করেছিলেন। ১০০ টাকার নোট, জুতা জোড়াসহ সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় নালায় ফেলেছিলেন তিনি। বর্ষার লাশ তিনদিন নালায় থাকার ফলে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়েছে কী না সেটিও একটি বিষয় বলেও জানান জিয়া হাবিব আহসান।












