মৎস্য খনি: আমাদের ‘হালদা’

নুসরাত সুলতানা | বুধবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ১:৩৬ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামবাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। প্রাচ্যের রানি হিসেবে সুপরিচিত, ঘন সবুজ সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম। পাহাড়, সমুদ্র ও নদনদীবেষ্টিত সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম আরো সমৃদ্ধ হয়েছে এশিয়ার একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী হালদার অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য গুণে। বিশ্বের আর কোনো জোয়ারভাটার নদী থেকে সরাসরি মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা যায় না, শুধুমাত্র হালদা নদী থেকেই তা সম্ভব। হালদা একান্তই আমাদের নিজস্ব নদী। হালদার উৎপত্তি, বিস্তার এবং সমাপ্তি সবই হয়েছে চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে। হালদা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাটনাতলী পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, ভুজপুর ও অন্যান্য অংশ, হাটহাজারী, রাউজান এবং চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও, বাকলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কালুরঘাটের নিকট কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ১০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সর্পিলাকার এ নদীর গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার। সারা বছরই বড় নৌকাগুলো নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার এবং ছোট নৌকাগুলো আরো ২০/২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অর্থাৎ নারায়ণহাট পর্যন্ত চলাচল করতে পারে। এই নদীর গভীরতা গড়ে ২১ ফুট এবং গভীরতম স্থানে এটি প্রায় ৩০ ফুট গভীর। পাহাড়ি অঞ্চলের কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি নদীপথে সহজেই পরিবহন করা যায়। চট্টগ্রাম শহরের পণ্যসামগ্রীর অধিকাংশই হালদা নদীপথে বড় মালবাহী নৌকার মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।

মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ি গ্রাম ‘সালদা’র পাহাড়ি ঝরনা থেকেই হালদার উৎপত্তি। উৎপত্তিস্থল থেকে হালদা প্রথমে দক্ষিণপশ্চিমে এবং পরে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। উত্তর হতে দক্ষিণে প্রবাহিত হালদায় পতিত দুপাশের উপনদীগুলোর বেশিরভাগই ছড়া, খাল কিংবা ঝরনা। পূর্বদিক থেকে এসে হালদায় মিলিত হওয়া মানিকছড়ি, ধুরুং, তেলপারই, সর্ত্তা, ডোমখালী এবং কাগতিয়া খালগুলোর উৎপত্তি হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে। পশ্চিম দিক থেকে আসা গজারিয়া, ফটিকছড়ি, হারুয়ালছড়ি, বারোমাসিয়া, মন্দাকিনী, বোয়ালিয়া এবং পোড়াকপালি খালগুলোর উৎপত্তি সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি রেঞ্জে।

হালদা নদী বাংলাদেশের কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র, যেখানে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ প্রভৃতি প্রজাতির মাছ সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাসে ডিম ছাড়ে। এশিয়ার একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী হালদা থেকে উপরোক্ত সময়ে মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। বর্ষাকালে পাহাড়ি ঢল ও অনুকূল পরিবেশে মা মাছের ডিম ছাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি হয়। হালদা নদীর বিশেষ আরো কতগুলো বৈশিষ্ট্যের জন্যে এখানে মামাছেরা ডিম ছাড়তে আসে। হালদায় পতিত পাহাড়ি ঝরনা ও ছড়ার উজানে এক বা একাধিক বিল, নদীর বাঁক, নদীর সুনির্দিষ্ট গভীরতা, অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রা, তীব্র খরস্রোত এবং পানির অতি ঘোলাত্বতা যা সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে, এগুলো অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এছাড়া কম কন্ডাক্টিভিটি এবং সহনশীল দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি রাসায়নিক কারণও আছে। হালদায় পতিত ঝরনা ও ছড়ার উজানে বিল থাকার কারণে বর্ষায় প্রথম বর্ষণের পর দুই কুলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়ে নদীর পানিতে প্রচুর জৈব উপাদানের মিশ্রণ হয়, ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে যা মাছের প্রজনন পূর্ববর্তী অবস্থাকে পরিপক্ক হতে সাহায্য করে। পাহাড়ি ঝরনা বিধৌত পানিতে প্রচুর মাইক্রো ও ম্যাক্রো পুষ্টি উপাদান থাকে যার ফলে নদীতে পর্যাপ্ত খাদ্যাণুর সৃষ্টি হয়। ঘন বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের কারণে নদীর বাঁকে প্রচণ্ড ঘূর্ণনের ফলে গভীর কূপের সৃষ্টি হয়। উজান থেকে আসা বিভিন্ন পুষ্টি ও অন্যান্য খনিজ উপাদান গভীর কূপগুলোর মধ্যে জমা হয় ফলে পানির ঘনত্ব বেড়ে যায়। মা মাছেরা সেই গভীর কূপ গুলোর মধ্যে ডিম ছাড়ার জন্যে আশ্রয় নেয়। গুরুত্বপূর্ণ এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে হালদা নদীতে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় বলেই রুই জাতীয় মাছেরা বর্ষাকালে ডিম ছাড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।

নদীর বাঁকে সৃষ্টি হওয়া কূপগুলোকে স্থানীয়ভাবে কুমবা কুয়াবলা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদায় প্রতিবছর এপ্রিল, মে ও জুন মাসের যে বিশেষ মুহূর্তগুলোতে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ ও কার্প জাতীয় মামাছেরা নিষিক্ত ডিম ছাড়ে সে বিশেষ মুহূর্তগুলোকে ‘তিথি’ বলা হয়। কার্প জাতীয় মাছ বলতে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, কমন কার্প, রাজপুটি ইত্যাদি মাছকে বুঝানো হয়। ডিম ছাড়ার ওই বিশেষ তিথিকে স্থানীয়ভাবে ‘জো’ বলা হয়। এপ্রিল, মে এবং জুন মাসের অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে ছয়টি ‘জো’ এর সময় মেঘলাদিনে দুপুরে কিংবা বিকেলে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টির পরে মামাছেরা ডিম ছাড়ে। ‘জো’ এর সময় বজ্রসহ বৃষ্টিপাত শুধুমাত্র স্থানীয়ভাবে হলে হবে না, বজ্রসহ বৃষ্টিপাত স্থানীয়ভাবে হওয়ার পাশাপাশি উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢল এসে নদীর পানিকে অত্যন্ত ঘোলাটে ও খরস্রোতা করে ফেনাকারে প্রবাহিত করবে। ‘জো’ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নদীতে জোয়ার ভাটার সৃষ্টি হওয়া। বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের পরে নদীতে জোয়ারভাটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে পূর্ণ জোয়ারের শেষে অথবা পূর্ণভাটার শেষে যখন পানি স্থির হয় তখনই কেবল মা মাছেরা ডিম ছাড়ে। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলকভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। ডিমের সেসব নমুনা দেখে ডিম ছাড়ার সেই শুভ তিথির আগেই স্থানীয় জেলে এবং ডিম সংগ্রহকারীরা নদীতে অবস্থান নেন এবং শুভক্ষণে ডিম সংগ্রহ করেন।

হালদা থেকে মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয় পুরোপুরি স্থানীয় পদ্ধতিতে। ডিম সংগ্রহকারীদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান থেকে স্থানীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতি অত্যন্ত প্রাচীন এবং নিতান্তই গ্রামীণ প্রচলিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের জন্য ২৩ জন মানুষ, একটি কাঠের নৌকা, ডিম ধরার জাল, দুটি নোঙ্গর, দুটি বড় বাঁশ, দুইটি বড় (১০/১২) লিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন প্লাস্টিকের বালতির প্রয়োজন হয়। সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম রাখার জন্য নৌকার মধ্যবর্তী জায়গায় কাঠ ও মাটি দিয়ে বিশেষভাবে একটি চারকোনা আকৃতির প্রকোষ্ঠ তৈরি করে রাখতে হয়। প্রতিটা প্রকোষ্ঠে ১০/১২ লিটার ধারণক্ষমতার ২৫ থেকে ৩০ বালতি ডিম রাখা যায়। নৌকার প্রকোষ্টে রাখা অবস্থায় ডিম ও পানির পরিমাণ সমান থাকতে হয়। এই প্রকোষ্টের ভিতর একটি সুতির মার্কিন কাপড় বিছানো থাকে। এই কাপড়ের উপরেই নিষিক্ত ডিমগুলো রাখা হয়। এই কাপড় দেওয়ার ফলে ডিমের পানি পরিবর্তনে এবং পরবর্তীতে ডিম ফুটানোর কুয়াতে ডিম পরিবহনে সুবিধা হয়। প্রত্যেক ঘণ্টায় পানি পরিবর্তন করতে হয়। নাহলে অক্সিজেন স্বল্পতা অথবা পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ডিম নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিষিক্ত ডিমগুলো নদী থেকে সংগ্রহের পর মাটির গর্তে বা কুয়ায় নিয়ে ফুটানো হয়। এটিও বহু বছরের চলমান অভিজ্ঞতার আলোকেই হয়। নিষিক্ত ডিম গুলো ফুটানোর জন্য নদীর পাড়ে চারকোনা বিশিষ্ট মাটির গর্ত তৈরি করতে হয়। গর্তগুলোর আকার স্থান ভেদে ভিন্ন সাইজের হয়। সাধারণত ৩/৪ ফুট গভীর গর্তগুলো ৮১৬ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৬১০ ফুট প্রস্থের হয়। মাটির এই গর্তগুলোতে মশারির কাপড়ের উপর নিষিক্তডিম রেখে চার দিন পর্যন্ত পরিচর্যার মাধ্যমে রেণুপোনা উৎপাদন করা হয়। ৪ দিন পর এই রেণুপোনাগুলো বিক্রয় যোগ্য হয়। হালদা নদী থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে আহরিত নিষিক্ত ডিম হতে বিশেষ পদ্ধতিতে রেণুপোনা ফুটানোর পর মিঠা পানির মাছ রুই, কাতলা, মৃগেল কালিবাউশ, কার্প জাতীয় মাছের রেণুপোনা জেলেদের হাত বদল হয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার মাছচাষী ও খামারীদের কাছে এবং বাণিজ্যিক হ্যাচারিতে সরবরাহ করা হয়। হালদার রেণুপোনার মৃত্যুহার খুবই নগণ্য এবং এই রেণুপোনা দ্রুত বর্ধনশীল বলেই সারাদেশে হালদার রেণুপোনার চাহিদা অনেক বেশি।

একক নদী হিসেবে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর অবদান অনেক বেশি। হালদা নদীর উৎপাদিত রেণুপোনা, মাছ হিসেবে ঘরে আসা পর্যন্ত দেশের মৎস্য খাতে চার ধাপে অবদান রাখে। হালদার একটি কাতলা মা মাছ তিন বছর বয়স থেকেই ডিম দেওয়া শুরু করে। ডিম ছাড়ার উপযোগী প্রতিটি মাছের ওজন সর্বনিম্ন ৫ কেজি থেকে সর্বোচ্চ এক মন পর্যন্ত হয়। এসব মাছ একসাথে ৫ থেকে ৪০ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে হালদার ৫ কেজি ওজনের ডিমওয়ালা একটি মাছ থেকে বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। তাঁদের মতে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ডিম ছাড়ে কাতলা মাছ। ১৮ থেকে ২০ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ প্রায় ৪০ লাখ ডিম দেয়। মা মাছ থেকে বছরে ৪ ধাপে আয় করা যায়। প্রথম ধাপে রেণু বিক্রি করে, দ্বিতীয় ধাপে ধানিপোনা বিক্রি করে, তৃতীয় ধাপে আঙ্গুলিপোনা বিক্রি করে, চতুর্থ ধাপে এক বছর বয়সী মাছ হিসেবে বাজারজাত করে। এভাবে চার ধাপে জাতীয় অর্থনীতিতে হালদা নদীর প্রত্যক্ষ অবদান বার্ষিক কমপক্ষে ৮০০ কোটি টাকারও বেশি। এই হিসেবে হালদা নদীকে প্রাকৃতিক এগ্রো মেগা ইন্ডাস্ট্রি বলে অভিহিত করেছেন হালদা গবেষকরা। রুই জাতীয় মাছের পরে হালদার অন্যতম প্রধান মাছ হচ্ছে গলদা চিংড়ি। গবেষকদের মতে, একটি পরিপক্ক গলদা চিংড়ি একসাথে ৬ থেকে ১০ হাজার ডিম ছাড়ে। কর্ণফুলীর মুখ থেকে মাদারীখালের মুখ পর্যন্ত এলাকার পোনা সংগ্রহকারীরা গলদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করে যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে গড়ে ওঠা চিংড়ির বাণিজ্যিক খামারগুলোতে সরবরাহ করে।

দখল, দূষণ, লবণাক্ততা, রাবারড্যাম নির্মাণসহ বিভিন্ন কারণে হালদা নদী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা গেছে, মনুষ্য সৃষ্ট দূষণের কারণে হালদায় কার্প জাতীয় মাছেদের ডিম ছাড়ার হার অনেকাংশে কমে গেছে।

বিভিন্ন ধরনের অপরিণামর্শী কর্মকান্ডের অনিবার্য পরিণতিতে হালদা তার আপন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে। বিরামহীন মারাত্মক দূষণ, ভরাট, বেদখল, নদীর পথে হরেক রকমের বাধা বিপত্তির কারণে হালদা মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। তাছাড়া আবহাওয়া ও জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন এবং নদীতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার বিস্তারে বিপন্ন অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রটি। দূষণের কবলে পড়ে অকালে অসময়ে মামাছেরা বিক্ষিপ্তভাবে ডিম ছাড়ছে। মাছের প্রজনন ও বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে বিষিয়ে উঠছে হালদার পরিবেশ। অপেক্ষাকৃত কম ডিম ছাড়ার কারণে এবং জেলেদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে হালদার মাছ। মা মাছেরা ডিম ছাড়ার আগে পরীক্ষামূলকভাবে অল্প ডিম ছাড়ে। অনুকূল পরিবেশ না পেলে মা মাছেরা ডিম নিজেদের দেহের মধ্যেই নষ্ট করে ফেলে। এদিকে প্রচলিত স্থানীয় পদ্ধতিতে ডিম সংগ্রহের কারণে নদী থেকে ২০২৫ পার্সেন্ট এর বেশি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা যায় না। ফলে অবশিষ্ট নিষিক্ত ডিম সাতআট ঘণ্টার মধ্যে জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে মিশে নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া প্রতিটা নৌকার জন্য যে পরিমাণ খরচ হয় তাতে জেলেদেরকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। প্রতিটা নৌকার সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম থেকে রেণুপোনা উৎপাদনের মাধ্যমে যে আয় হয় তাতে ব্যয়ের সাথে সামঞ্জস্য থাকে না। ফলে দরিদ্র জেলেরা মাছের ডিম সংগ্রহে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, চড়া সুদের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে দিশাহীন হয়ে পড়েন, তাই তারা এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে ডিম সংগ্রহকারীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ডিম সংগ্রহের কাজ অত্যন্ত শ্রম নির্ভর। প্রতিটা নৌকায় ২৩ জন লোক ছাড়া ডিম সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। দুই তিন জন লোকের পরিশ্রমের বিনিময়ে যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয় তা শ্রমের তুলনায় খুবই নগণ্য। জানা গেছে, পঞ্চাশের দশকে সারাদেশের মোট চাহিদার ৭০% এরও বেশি রেণুপোনা সরবরাহ হতো হালদা থেকেই। আগে যে পরিমাণ ডিম সংগ্রহ করা হতো এখন তার সিকি ভাগও সংগ্রহ করা যায় না। জাতীয় অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহনকারী হালদা, বাংলাদেশের কার্প জাতীয় মাছের একমাত্র বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক ‘জিন ব্যাংক’ বিভিন্নভাবে দূষণের শিকার। উজানে পাহাড়ে জুম চাষ, বৃক্ষনিধন ইত্যাদি কারণে বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলের সাথে প্রচুর পলি, মাটি, বালি হালদার ভাটির দিকে নেমে আসে। তাছাড়া হালদার শাখা খালছড়াগুলোতে অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরি, রাবারড্যাম, স্লুইসগেট নির্মাণের কারণেও পানির চাপ এবং স্রোতের গতি কমে গেছে। ফলে উজান থেকে আসা পলিমাটি তলানিতে জমা হয়ে নদী ভরাট হচ্ছে। রুই, কাতলা জাতীয় মাছ ধরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরও হালদার তীরবর্তী এলাকায় অবৈধ মৎস্য শিকারীরা রাতের আঁধারে প্রতিনিয়ত মাছ শিকার করে। এছাড়া অবৈধ ও বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলনের ফলে মা মাছের নিরাপদ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয় এবং বালু উত্তোলনের ফলে জোয়ার ভাটার প্রভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। হালদা বঙ্গোপসাগরের অনতিদূরে হওয়ায় জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় ৭২৭৫ প্রজাতির মাছ ছিলো বলে গবেষণায় জানা গেছে। বর্তমানে হালদায় ডলফিন সহ প্রায় ৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। কালের পরিক্রমায় অন্তত ১৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

হালদা নদীকে বাংলাদেশের ‘সাদা সোনার খনি’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। কৃষি খামার সহ বিভিন্ন খাতে নদীটির অবদান বার্ষিক কয়েক হাজার কোটি টাকার সমান। কৃষিজ উপাদান সহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলাফল যুক্ত করলে দেখা যায় হালদার অবদান অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। একক নদী হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে হালদার অবদান অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম মহানগর ও এর আশেপাশে ৬০ থেকে ৭০ লাখ অধিবাসীর সুপেয় পানির প্রধান উৎস হালদা। চট্টগ্রাম ওয়াসা হালদা থেকে পানি উত্তোলন করে শোধনাগারের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে আঠারো কোটি লিটার পানি সরবরাহ করে নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করছে।

নদী গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের অসংখ্য নদী থেকে হালদা নদীর পরিবেশগত বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। হালদার সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য নদী যেমন, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ইত্যাদির সাথে সংযোগ না থাকায় এখনো পর্যন্ত কার্প জাতীয় মাছের ‘জিনগত মজুদ’ সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে হালদা নদীর সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব। বাংলাদেশের কার্প হ্যাচারি তথা বাংলাদেশের অ্যকুয়াকালচার এবং বায়োডাইভার্সিটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদার প্রাকৃতিক উৎসের গলদা চিংড়ি ও কার্প জাতীয় মাছের পোনার গুরুত্ব অপরিসীম। ‘মৎস্য খনি’ খ্যাত হালদা নদী আমাদের ঐতিহ্য। হালদা শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয় এটি কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস। এ নদী জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি আমাদের প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদাও উল্লেখযোগ্যহারে পূরণ করে। হালদা নদী কেবল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য নয়, ইউনেস্কোর শর্ত অনুযায়ী ‘হালদা’ বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্যেরও যোগ্যতা রাখে। খ্যাতিমান মৎস্য, পানি, কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এবং স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী ও জেলেদের মতামতের ভিত্তিতে পরিকল্পিত, দীর্ঘমেয়াদী ও বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রকল্প প্রণয়ন করে চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ‘হালদা’কে রক্ষা করা সময়ের দাবি।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে চমেক শিক্ষার্থীদের ভূমিকা রাখতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধকল্পলোকের মেরিন ড্রাইভ : কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা নতুন পর্যটন কেন্দ্র