ম্যাক্সিম গোর্কীর মা

সমাজ বাস্তবতার অনন্য দলিল

এস ডি সুব্রত | শুক্রবার , ১১ এপ্রিল, ২০২৫ at ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

ম্যাক্সিম গোর্কীর বিশ্ব বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাসের প্রধান বিষয় পাভেল এবং তার মা পেলাগোয়া নিলভনার সম্পর্কটি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য তৈরি হতে থাকা রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা উপস্থাপন করা হয়েছে এউপন্যাসে । স্বামীর সংসারে অবহেলিত নির্যাতিত একজন নারী একসময় হয়ে উঠেন রাজনীতি সচেতন মানুষ । পুত্র পাভেলের স্বপ্ন ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ছেলের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে “মা” ও হয়ে উঠেন সময়ের সৈনিক। উপন্যাসে গোর্কী আরও কিছু সাহসী নারী চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। নাতাসা, শাসা, লোডমিল্লা, সোফিয়া ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিপ্লবে নেমেছেন। আরামদায়ক জীবনে থেকেও সংগ্রামী হয়েছেন সাধারণ মানুষের কথা ভেবে। ১৯০২ সালের মে দিবসের প্রেক্ষাপটে সাজানো “মা” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পেলগোয়া নিলভনার সংগ্রামী জীবন নারী পুরুষ তথা এই সমাজের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যুগে । বিখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কি ১৮৬৮ সালের ২৮ মার্চ রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ম্যাক্সিম গোর্কি তার ছদ্ম নাম। তাঁর আসল নাম অ্যালেক্সি ম্যাক্সিসোভিচ পেশকভ। গল্পটি শুরু হয়েছে কারখানার শ্রমিকদের দৈনন্দিন নিদারুণ কষ্টের আর একঘেয়ে জীবনের বর্ণনা দিয়ে । একটি উপন্যাস একটি জাতির বিবেককে বদলে দিয়েছে, তুমুলভাবে আলোকিত করেছে। এমন উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে আর আছে বলে মনে পড়ে না।পেলাগেয়া নিলভনা নামের একজন অতিসাধারণ মেয়ে মানুষ কি করে সময়ের প্রয়োজনে আস্তে আস্তে রূপান্তরিত হন একজন রাজনীতি সচেতন ব্যাক্তিতে, বুঝতে শেখেন সারাজীবন কি করুণ কাটিয়েছেন শ্রেণীগত নির্যাতন ও লিঙ্গ অবস্থানের অসহায়তার শিকার; তা চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন গোর্কি তার লেখা এই উপন্যাসটিতে। কারখানার শ্রমিকদের দৈনন্দিন নিদারুণ কষ্ট আর একঘেয়ে জীবন। যেখানে নেই কোনো আনন্দ, নেই কোনো উচ্ছা্বস। যেখানে প্রতিদিন কারখানার যন্ত্র তাদের ভিতর কার রক্ত চুষে নিচ্ছে, তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর গহ্বরের দিকে। তাদের কোনো ইচ্ছা ছিলো না এই জীবন ধারাকে পরিবর্তন করে সুখের হাসি হাসবার। তাদের জীবন চলে যন্ত্রকে নিয়ে। এভাবেই তারা যন্ত্রমানবে রূপান্তরিত হয়, যে মানবের ভিতরে কোনো আবেগ নেই, নেই কোন উচ্ছ্বাস। তাদের মন ব্যধিগ্রস্ত হয়ে পড়ে দরিদ্রতার কারণে । ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা মা উপন্যাসটি মূলত বাস্তব চরিত্রে লেখা। পিওতর জালোমভ আর তার মা আন্না কিরিলোভনারই ছিলেন উপন্যাসের পাভেল ভ্‌লাসভ আর তাঁর মা পেলেগোয়া নিলভনা। উপন্যাসের নিলভনা মতোই আন্নাকিরিলোভনার জীবনেও সুখ ছিলো না। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারটিকে সেই টিকিয়ে রাখে। পিওরতরের বিপ্লবী চক্রে যোগ দেয়ার পর পরই তার গোটা পরিবাই এ আন্দোলনে যোগ দেয় । পিওতরের সাইবেরিয়া নির্বাসনেও তাকে সত্য প্রচারে বাধা দেয়া হয় নি। সেসময় গোর্কিই জালোমভের পরিবারে নিয়মিত টাকা পাঠাত। এমনকি জালোমভের নির্বাসন থেকে পালাতেও গোর্কিই সাহায্য করে । জালোমভ অনেক কষ্টের মধ্যে থেকেও এ আন্দোলন থামায় নি। সে তার এক চিঠিতে লিখেছিলেনআমি চাই গোলাম যেন না থাকে, গোলামদের আমি ভালোবাসি না। ভালোবাসি যোদ্ধাদের। যাদের মধ্যে দেখি স্বাধীন মানুষের পৌরুষ। ভালোবাসি সেইসব মানুষকে। এমনইভাবে পহেলা মেকে সার্থক বানাতে এগিয়ে এসেছিলো বিপ্লবের এক সাধারণ সৈনিক পিওতর জালোমভ। পাভেল ভ্‌লাসভ একজন শ্রমিক।সে শ্রমজীবী মানুষের জীবন বদলে দিতে চায়। তাই মা তার ছেলের জন্য সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে। কিন্তু একা পাবেল এটা করবেই এমন নয় । সে পাশে পেয়ে যায় নাতাশা, নিকলাই,রীবন, সোফিায়, সিজব আরো কয়েকজনকে। এক সময় মায়ের মাঝে ধ্বনিত হয় আন্দোলনের বীজ। মা বুঝতে পারে তার জীবন বদলে গেছে। এক সময় স্বামীর হাতে মার খাওয়াই যে নারীর নিত্যদিনের ব্যাপার ছিলো, সেনারী এখন এক শ্রমিক নেতার মা। এমন ছেলে নিয়ে মা মনে মনে গর্ব করতেন। মায়ের সাহায্যে চলতে থাকে গোপন আন্দোলনের প্রস্তুতি। কিন্তু এক সময় পুলিশ জেনে যায় আন্দোলনের খবর । পাভেলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং সাইবেরিয়ায় যাবজ্জীবন নির্বাসন দেয়। তখন পাভেলের মা কারখানার মধ্যে নিজেই বিপ্লবী লিফলেট বিতরণ করে। আদালতে পাভেল যে বক্তৃতা দেয় সে বক্তৃতা ছাপা বেআইনি প্রচারপত্রে স্যুটকেস সহ নিলভনা ধরা পরে সশস্ত্র পুলিশের হাতে। এভাবে চলে নানা অত্যাচার। কিন্তু মা অটল থাকেন বিপ্লবীদের সাহায্যে। মা ওদের বলছে : মূর্খের দল ! দিন দিন নিজেদের বোঝা নিজেরাই বাড়িয়ে চলেছিস কেবল। একদিন সে ভারে তোরা নিজেরাই নুয়ে পড়বি। ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা মা উপন্যাসটি মূলত বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা । পিওতর জালোমভ আর তাঁর মা আন্না কিরিলোভনাই ছিলেন উপন্যাসের পাভেল ভ্‌লাসভ আর তাঁর মা পেলাগোয়া নিলভনা। সে সময় ম্যাক্সিম গোর্কি জালোমভের পরিবারে নিয়মিত টাকা পাঠাত। জালোমভ অনেক কষ্টের মধ্যে থেকেও এ আন্দোলন থামায়নি। এমনই ভাবে পহেলা মেকে সার্থক বানাতে এগিয়ে এসেছিলো বিপ্লবের এক সাধারণ সৈনিক পিওতর জালোমভ। তিনি যেমন মুগ্ধ করেছেন গোর্কিকে তেমনই আমাদের মুগ্ধ করেছেন তার নৈতিক শুচিতায়। বিশ্ব সাহিত্যের অমর সৃষ্টি মা বিপ্লবী সংগ্রামে অচেতন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে শ্রমিক যোগ দেয়, কীভাবে সে সঠিক আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে অবিচল দৃঢ়তায় লক্ষ্যাভিমুখী এগিয়ে চলে, এটা বোঝা যায় ‘মা’র পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। দুনিয়া পরিবর্তনের আদর্শ ধারণ করে যে শ্রমিক, পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তাকে হয়ে উঠতে হয় কর্তব্য সাধনের উপযুক্ত নৈতিকবোধের ও সংগ্রামী চেতনার অধিকারী।

পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকের জীবন বংশ পরম্পরায় একই থাকে। পাভেলের জীবন তার বাবার জীবন থেকে ভিন্ন কিছুই হতো না, যদি সে আদর্শের সন্ধান না পেত। পাভেলের বন্ধু খখল মাকে বলে, “ওরকম জীবন যে কী সাংঘাতিক বিশ্রী, সেটুকু তো আপনি বুঝতে পেরেছেন, হাজার হাজার লোক তারা আপনার চেয়ে অনেক ভাল জীবন পেতে পারে, তবুও তারা থাকে জানোয়ারের মতো। আজ দেখছি মানুষ খাটছে। কালও তাই। সারা জীবন ঐ করবে। এক সময় বিয়ে করবে, ছেলেপুলে হবে, ছেলেপুলে নিয়ে খেলা করবে। কিন্তু যেই তারা আরো বড় হয়, মুখ বাড়ে, পেট বাড়ে, তখনই ফ্যাসাদ বাঁধে। তখন আরম্ভ হয় গালিগালাজ আর শাপমন্যি। সারাদিন চেঁচায় : শুয়োরগুলোকে বসিয়ে রেখে আর খাওয়াব ক’দিন। বাড়ুক শিগগির, খাটার সময় হয়েছে। ছেলেপুলেকে পোষা জন্তুর মতো পরিণত করতে চায়। তারা পেটের জন্য খাটতে শুরু করে আবার সেই একই জীবনের পুনরাবৃত্তি।” মানুষের মনের এই যে দাসত্ব শৃঙ্খল, এ শৃঙ্খল ভাঙার ব্রত যারা গ্রহণ করেছে তারাই আসল মানুষ। শ্রমিক জীবনের এ দুঃসহ ধারাপাত, প্রতি মুহূর্তে মনুষ্যত্ব খোয়ানো চূড়ান্ত গ্লানির এজীবন কীভাবে আদর্শের সংগ্রামে নতুন জীবনের ভবিষ্যৎ পথ রচনা করে গোর্কির এ লেখায় তা ফুটে উঠেছে। এটা হতে পারে তখনই, যখন শ্রমিকদের মধ্যে জীবনের যথার্থ ধারণা, মর্যাদাবোধ আর প্রবল আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায়। তারা যখন ভাবে, “শুধু এক পেট খেতে পাওয়াটা আমাদের সব নয়। যারা আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসে আছে, আমাদের চোখে ঠুলি এঁটে রেখেছে, তাদের দেখাতে হবে আমরা সব দেখতে পাচ্ছি। আমরা বোকা নই, জানোয়ার নই যে পেট পুরে খেতে পেলেই খুশি থাকবো, আমরা বাঁচতে চাই। শত্রুদের দেখাতে হবে, যত নিচেই তারা আমাদের ফেলে রাখুক, যত অত্যাচার করুক, আমরা মানুষ এবং জ্ঞানের মাপকাঠিতে তাদের সমান হতে বাধা নেই, এমনকি তাদের চেয়ে বড় হতে…” তখন শ্রমিকের মনে নতুন শক্তির উদ্বোধন ঘটে। যথার্থ জ্ঞান ও ইতিহাসচেতনা তাকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের পরিসর থেকে টেনে আনে আন্তর্জাতিকতা আর বিশ্বভ্রাতৃত্বের বৃহত্তর সীমানায়। দিগন্ত প্রসারিত এক মহামিলনের প্রবল আকাঙক্ষায় উদ্বেলিত হয় সে : “আমাদের সবার হাসিকান্না এক হয়ে গেছে। আমরা জাতধর্ম জানিনে, আমরা শুধু জানি দোস্ত আর দুশমন। সারা দুনিয়ার যত শ্রমিক সবাই আমাদের বন্ধু আর বড়লোক আর সরকারের লোক আমাদের শত্রু। দুনিয়ার দিকে ভালো করে তাকালে বুঝি কত শ্রমিক আমরা আছি সারা পৃথিবীতে, আর কী শক্তি আমাদের। ন্যায়ের আকাশে সূর্যটা জ্বলছে ঝলমল করে। সেই আকাশটা শ্রমিকের মনে। সমাজতন্ত্রী হলে সে নিজেকে যাই বলুক না কেন, সে আমাদের ভাই। এক ভাবনায় বাঁধা সত্যিকারের ভাই। আজকের, কালকে ও চিরকালের ভাই।” পাভেল মাকে বলে, “প্রথমে নিজে জানবো, তবে অন্যদের জানাতে পারবো।” কতটা জীবনতৃষ্ণা আর বিপ্লবী স্পৃহা থাকলে একথা ভাবা যায়, যখন পাভেলের বন্ধু খখল মাকে এ বয়সেও পড়াশোনা করার উৎসাহ যোগায়। বলে, “আমরা সবাই বৃষ্টির ফোঁটার মতো। বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা ফসল ফলাবার কাজে লাগে। পড়তে একবার আরম্ভ করুন তো দেখি।” আজ সামাজিক আন্দোলন, বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মীদের এ কথা ভাবতে হবে তাঁরা এ জ্ঞান চর্চায় কতখানি একাগ্র, কতটা উদ্দেশ্যমুখীন।

ম্যাক্সিম গোর্কির অন্যসব গল্পে যেমন রাশিয়ায় তৎকালীন সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে , মা উপন্যাস তার চেয়ে বেশী বাস্তবতার দলিল যা মানব মনকে নাড়া দিয়েছে প্রবলভাবে ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযুদ্ধ, মাতৃত্ব ও কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধন্যাশনাল গ্রামার স্কুলের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান