দীর্ঘ লোকসান আর ঘাটতির মন্দা কাটিয়ে অবশেষে উৎপাদন মৌসুমের শেষ লগ্নে এসে বেড়েছে দেশের সাদা সোনা খ্যাত লবণের দাম। মৌসুমজুড়ে প্রতি বস্তা (দুই মণ) লবণের দাম ছিল ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা, যা মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে প্রতি বস্তা ৮০০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি মণ লবণের দাম এখন ৪০০ টাকা। প্রতি বছরই মৌসুম শেষে লবণের দাম বাড়ে। তবে চলতি বছরে দাম বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি। মাঠে পড়ে থাকা লবণ হঠাৎ করেই লাভের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ফলে নিরাশ চাষীদের মুখে ফুটেছে আশার হাসি। মৌসুমের ছয় মাসের কঠোর পরিশ্রমে তিলে তিলে তৈরি করা লবণ ভালো দামে বিক্রি করতে চাষীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। গত কয়েক মাস ধরে লবণের মূল্য বৃদ্ধিতে লবণ চাষী, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা মহেশখালী ও কক্সবাজার জেলা সদর এমনকি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনেও আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছিলেন। সামপ্রতিক সময়ে লবণের মূল্য বৃদ্ধিকে আন্দোলনের ফসল বলে মনে করছেন চাষীরা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মহেশখালীর হোয়ানক, কালারমারছড়া, বড় মহেশখালী ও শাপলাপুর ইউনিয়নের মাঠে চলছে লবণ উত্তোলনের শেষ ধাপ। বাজারে দাম বাড়ায় উৎসাহিত হয়ে অনেক চাষী এখন বিক্রি করছেন আগের গর্তে মজুত রাখা লবণও। কেউ কেউ আশা করছেন দাম আরও বাড়বে, তাই আপাতত অপেক্ষা করছেন। মাঠের গর্তে রাখা লবণ যেমন বিক্রি হচ্ছে, তেমনি পুরোনো দেনা পরিশোধে কিছুটা স্বস্তিও মিলেছে। লবণের উৎপাদন সরঞ্জাম, শ্রমিকের মজুরি ও পরিবহন ব্যয়ের চাপ সইতে না পেরে মৌসুমজুড়ে হতাশায় ছিলেন চাষীরা। দাম বাড়ায় সেই হতাশা এখন কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে বলে জানান তারা।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, একজন চাষী গড়ে তিন কানি জমিতে লবণ চাষ করেন। জমি ইজারা, পলিথিন, পানি, লবণ ক্রিস্টালাইজার, লবণ তোলার যন্ত্র ও শ্রমিক–মজুরি মিলিয়ে ব্যয় হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এত খরচে উৎপাদন হয় প্রায় ৯০০ মণ লবণ। মৌসুমের প্রথম দিকে যখন লবণের দাম ছিল প্রতি মণ ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, তখন বিক্রি করে মোট আয় হতো সর্বোচ্চ ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা। কিন্তু এখন দাম মণপ্রতি ৪০০ টাকা হলে আয় হবে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা থেকে খরচ বাদেও থাকে ভালো মুনাফা।
স্থানীয় বাজারে দাম বাড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রথমত, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কিছুটা কম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মৌসুমজুড়ে দাম কম থাকায় চাষীরা আগেভাগে বিক্রি করতে চাননি, ফলে বাজারে সরবরাহ কমেছে। এছাড়া পরিবহন সংকট, শিল্পকারখানায় কাঁচামালের চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং পাইকারি পর্যায়ে কিছুটা কারসাজির অভিযোগও রয়েছে। এদিকে ক্রেতাদের একাংশ অভিযোগ করছেন, দাম বাড়ার ফলে নিত্যপণ্যের বাজারেও প্রভাব পড়ছে, যদিও উৎপাদকরা তা অস্বীকার করছেন।
দামের এই উত্থান চাষীদের জন্য স্বস্তির হলেও, নীতিনির্ধারকদের জন্য এটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, প্রতি বছরই মৌসুম শেষে দাম বাড়ে, অথচ সরকার মৌসুমজুড়ে কোনও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেয় না। ফলে উৎপাদক দাম পান না, ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যায়। তাই মাঠ পর্যায়ে সংগঠিতভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা, মজুত ও সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং দালালচক্র নির্মূল ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। দাম বাড়ার এই ক্ষণস্থায়ী স্বস্তি যেন আগামীতে বিপর্যয়ে রূপ না নেয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে এখনই।
মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের চাষী আবদুল খালেক বলেন, লবণের দাম এমন বেড়েছে, চোখে পানি এসে গেছে। সারা মৌসুমে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, এখন মুখে হাসি ফুটেছে। তবে এমন দাম আগে থাকলে আরও বেশি লাভ করতে পারতাম। একই ইউনিয়নের আরেক চাষী শফিউল আলম বলেন, আমি শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। গর্তে লবণ জমিয়ে রেখেছিলাম। এখন ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। ধারদেনা শোধ করে এবার একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারব। তাদের মতে, দাম আরও বাড়লে নতুন করে চাষে উৎসাহ পাবেন সবাই।
কঙবাজার বিসিকের উপ–মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, চলতি বছরে কেবল মহেশখালীতেই ১৭ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হয়েছে। ২০২৫–২৬ অর্থবছরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। এর অন্তত ২৫ শতাংশই আসে এই দ্বীপ উপজেলা থেকে। তিনি বলেন, উৎপাদন বেশি হলেও মাঠ পর্যায়ে চাষীরা বাজার ব্যবস্থাপনার অভাবে দাম পাচ্ছেন না। তবে এ বছর শেষ মুহূর্তে এসে কিছুটা স্বস্তি মিলছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এ সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছাড়া লবণ শিল্পের পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। মাঠভিত্তিক মজুত ও সংরক্ষণ সুবিধা, দালাল ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদকদের সহজ শর্তে ঋণ এবং সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা না থাকলে আগামী মৌসুমে চাষী কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে। এমনকি অনেক পুরোনো মাঠও পড়ে থাকবে খালি। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। অতএব, মৌসুমের শেষ মুহূর্তে বাড়া দামে খুশি হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার বিষয়েও এখনই উদ্যোগ নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের।