মৌমাছি ও মানুষ

প্রফেসর মো. শাহ আলম | শুক্রবার , ৩০ আগস্ট, ২০২৪ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

২৪ জুলাই অনন্তের পথে চলে গেলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মাহবুবুল হক। যিনি ছিলেন আমার সমসাময়িক সহকর্মী। প্রায় ছ’মাস আগে তিনি আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর একটি বইয়ের ওপর আলোচনামূলক লেখা দেয়ার জন্য। বইটির নাম ‘মৌমাছি ও মানুষ’। লেখক নাউম ইত্তরিশ। তিনি বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন। যেহেতু আমার পঠিত বিষয়ের সাথে বইটি সম্পর্কিত সেজন্যই তিনি এ কাজটির জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন।

নাউম ইত্তরিশ (N. Ioyrish) এর ইংরেজিতে লেখা বই ইববং ধহফ চবড়ঢ়ষব. বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক। তিনি বইয়ের নাম করেছেন মৌমাছি ও মানুষ। বইটির মূল লেখা পৃষ্ঠা ২৬১। বইটিতে অধ্যায় রয়েছে দশটি যথাক্রমে ১। যুগে যুগে মৌমাছি পালন ২। মৌমাছির জীবন বিজ্ঞান ৩। মধু ও তার গুণ। ৪। ভেষজ ও ভিটামিন যোজিত মধু প্রাপ্তির ত্বরিত পদ্ধতি ৫। ওষুধ ও প্রতিষেধক হিসাবে মধু ৬। বাসগৃহে মধু, ৭। মৌমাছির বিষের আরোগ্যকর গুনাগুণ, ৮। মৌমাছির মোম ও অন্যান্য মৌজাত সামগ্রীর আরোগ্যকর গুনাগুণ ৯। মৌকল্পরাজ্য ১০। যাদুর কুয়ো।

লেখক ভূমিকায় যা লিখেছন আমার কথাও তাই “বইটি মৌমাছি প্রেমিকের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করবে এবং তাঁদের কাজকর্মের ভেতর দিয়ে বাড়বে মধু ও অন্যান্য সংগ্রহের কাজ। আনন্দ ও স্বাস্থ্যময় কাজ যেমন তারা পাবেন তেমনি বাড়বে ফল ও বীজের ফসল।”

. মাহবুবুল হক ভূমিকায় লিখেছেন “এ বইটি মৌমাছি পালন বিষয়ে কোনো পাঠ্যবই নয় কিংবা ভেষজ গবেষণাগ্রন্থ বা ঔষধিশালাও একে বলা যাবে না।” এ অংশটুকুতে লেখকের সাথে আমি একমত নই। কারণ বইটি পড়ে শেষ করেই আমি একজন কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে বলছি এটি অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। গবেষণাগ্রন্থ ও ঔষধিশালা হিসেবে এটি একটি বিশেষ স্তর পর্যন্ত বিবেচ্য ও গ্রহণযোগ্য। অধ্যায়ের ক্রম অনুসারে মৌমাছি বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

প্রথম অধ্যায়: এখানে মৌমাছিকে একটি উপকারী পোকা বা পতঙ্গ বলা হয়েছে। মিশরীয় সভ্যতার প্রায় তিন হাজার খ্রি. পূ: সময়ে মৌমাছির গুরুত্ব লিখা হয়েছে। সময়ের ধাপে ধাপে মেসোপটমিয়া প্রাচীন গ্রীস ও রোমে বন্য মৌমাছি মধু সংগ্রহের উল্লেখ রয়েছে। এক হাজার বছর আগে রাশিয়ায় মৌমাছি পালন ও বনমধু সংগ্রহকারীদের অধিকার রক্ষামূলক আইন তৈরি করা হয়। মধ্যযুগে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ায় মধু পরিমাণ ও চাষের কথা উল্লেখ করা হয়। ইউক্রেনের মৌমাছিপালক প. ই প্রোকোপোভিচ (১৭৭৫১৮৫০ খ্রি.)প্রথম গুটানো ফ্রেমের মৌচাক বা বাক্স উদ্ভাবন করেন।

দ্বিতীয় অধ্যায় : Life history of honey bee” মৌমাছির জীবন বিজ্ঞানের পরিবর্তে বাংলায় প্রচলিত মৌমাছির জীবন ইতিহাস সংজ্ঞা এ অধ্যায়ে মৌমাছির জীবন ইতিহাস বেশ ভালোভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে রাণী, কর্মী ও পুরুষের দায়িত্ব পালনের কথা বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মৌমাছির দেহের অঙ্গের ছবি দেয়া হয়েছে। অঙ্গগুলোর নাম বাংলায় করা হয়েছে তবে আমি এ সংজ্ঞা বা নামগুলো মূল শব্দের বাংলা বানানে লিখা পছন্দ করি। এ অধ্যায়ে মৌমাছি পালনের বাক্সের পরিচ্ছন্নতা বিষয়েও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

তৃতীয় অধ্যায়: এ অধ্যায়টি একটি বড় অধ্যায়। এখানে বর্ণনা করা হয়েছে মৌমাছিরা মধু বানায় কেমন করে। মধুর প্রকার, মৌমাছিদের প্রশিক্ষণ, মধুর রাসায়নিক উপাদান ও পুষ্টিক্ষমতা, মধুর ভিটামিন, মধুর ছত্রাকবিনাশী গুণাগুণ, প্রাকৃতিক মধুর প্রকার, মাদকতা সৃষ্টিকারী মধু, কৃত্রিম মধু ও মধু সংরক্ষণ পদ্ধতি।

চতুর্থ অধ্যায়: মৌমাছি দিয়ে মধু তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে বেশী মধু সংগ্রহ করা যায়। এ পদ্ধতিতে মৌমাছিকে কৃত্রিম নেকটার (Nectar ) বা সিরাপ সরবরাহ করে মধু তৈরি ত্বরান্বিত করা হয়। মৌ বাক্সের কাছাকাছি এ সিরাপ রাখা হয়। কৃত্রিম নেকটারের সাথে বিভিন্ন ওষুধ, ভিটামিন বা খনিজ পদার্থের যৌগ মিশিয়ে দিলে মৌমাছি যে মধু তৈরি করে তাতেও ওষুধ ও খনিজ পদার্থ মধুতে রয়েছে যায় ফলে মৌাচাক একটি ওষুধ তৈরির কারখানা হয়ে যায়।

পঞ্চম অধ্যায় : ওষুধ ও প্রতিষেধক হিসেবে মধুর ব্যবহার বিষয়ে লেখা হয়েছে। পথ্য উপাদান, নিরাময়কারী, বলবর্ধক, যৌবন সংরক্ষক হিসেবে মধু খাওয়া হয়েছে। নানা রকম আন্ত্রিক প্রদাহে ও বিষক্রিয়ায়। মুখের ঘায়ে, ক্ষুধামন্দায়, স্মরণ শক্তির ঘাটতিতে, বুদ্ধির অপরিপক্বতার জন্য, দেহের ক্ষতের জন্য ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। হৃৎপিন্ড, পরিপাক, স্নায়ুতন্ত্র, চোখ ও শিশু শারীরিক বিকাশে মধু খাওয়ানো হয়েছে। ভেষজ লতাগুল্মের সাথে ও চায়ের সাথে মধুর ব্যবহার হয়েছে।

ষষ্ঠ অধ্যায়: খাদ্য ও প্রসাধনে মধু ব্যবহার লিখা হয়েছে। কেক, মিষ্টি, হালুয়া, চাটনি, বিস্কুট, রুটি, মোয়া, ক্ষীর, লুডলস, ফল, সবজি, সালাদ, ছানার সাথে মধু মিশিয়ে প্রায় ৪০ প্রকার খাবারের বর্ণনা রয়েছে। সরবত ও পানীয় তৈরি করা যায় প্রায় ১৭ প্রকার আচার ও জেম তৈরি করা যায় ৫ প্রকার।

প্রসাধন ও লোশনে মধু ব্যবহৃত হয়। ক্রিমে মোমের ব্যবহারও রয়েছে।

সপ্তম অধ্যায়: মৌমাছির বিষের আরোগ্যকর গুণাগুণ সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে মৌ বিষের গঠন, গুণাগুণ, ক্রিয়াপদ্ধতি, বিষের প্রতি সংবেদনশীলতা, রোগের চিকিৎসা (স্নায়ুপ্রদাহ ও স্নায়ুশূল, চক্ষুপ্রদাহ, বাত, রক্তচাপ, চর্মরোগ) পদ্ধতি, মৌবিষ প্রয়োগ করার পদ্ধতি/ হুল, মৌ অধিবিষ টেবলেট মলম) বিষ সংগ্রহের পদ্ধতি, চিকিৎসাকালীন খাদ্যগ্রহণ বর্ণনা করা হয়েছে।

অষ্টম অধ্যায় : মৌমাছির তৈরি মৌজাত সামগ্রীর উপাদান ও ব্যবহার বর্ণণা করা হয়েছে। যেমন মোম মৌআটা (Propolis ) পরাগ ও রানী ভোগ (Royal Jelly ) .

নবম অধ্যায়টি খুব ছোট কয়েকপৃষ্ঠার হলেও এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে মৌ খামার বা মৌবাগিচার বাতাস নির্মল ও সতেজ। যারা মৌচাষ করেন তারা দীর্ঘজীবী হন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে শহর থেকে বেশ দূরে মৌনগর বা মৌকল্পরাজ্য করা যেতে পারে। যা স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা আরোগ্য নিকেতন হবে সে সাথে সেখানে বৃদ্ধাবাস করা যেতে পারে ।

দশম অধ্যায়: মৌমাছির বিভিন্ন বিষয়ে স্পারটার (৮৮০ খ্রী. পূ🙂 লিকারগাস থেকে শুরু করে এরিস্টোটল, ভার্জিল হয়ে আলেকজান্দার গুবিন ও রেমি শাঁভো (১৯১৩ খ্রী.) পর্যন্ত ৮২ জন মানুষের দেয়া তথ্যের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তবে তাঁদের অধিকাংশই রাশিয়ার অধিবাসী। তারপরও মৌমাছি সম্বন্ধে শেষ কথা বলে কিছু এখনও হয়নি।

বইটিতে ৪৯টি গ্রন্থ বা গবেষণা পত্রের তথ্য দেয়া হয়েছে। পরিভাষা বিষয়ে আমার মন্তব্য এরকম যে সব বিদেশি শব্দের বাংলায় প্রকাশের প্রয়োজন নেই। সবশেষ হলেও একেবারে প্রথমে সূচিপত্রে তৃতীয় অধ্যায়ে লিখতে হবেমধু ও তার গুণ পৃ. ৪।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন বাংলাদেশের স্বপ্নকে প্রাধান্য দিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধগানের ভুবনে নজরুল