মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন : মানবপ্রেমের উজ্জ্বল আলো

মোস্তফা কামাল পাশা | রবিবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ


সময় ১৯৮৫। মাস মনে নেই। হঠাৎ আমার মা ষ্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। বাবা হারিয়েছি দশম শ্রেণিতে থাকতে-পৃথিবী চেনার আগেই। পরপরই বড়বোন এক সন্তান রেখে। বড়ভাই চার সন্তান রেখে হ্রদরোগে চলে যান ৭৪ সালে। কৈশোর ছোঁয়ার আগেই পরিবারে মৃত্যুর থাবা একের পর এক নখর গাঁথতে থাকে! বড় বলে সংসারের দায় চাপে আনাড়ি ঘাঁড়ে।
মা’ই আমাদের সব। আমি তখন দৈনিক আজাদীতে। শহরে থাকি, সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়ি যাই। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক বাড়ি ছুটে যাই। স্থানীয় ডাক্তারের নির্দেশে ততক্ষণে মা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালের পথে। বাস থেকে নেমে খবর শুনে ফের শহরে চ মে ক হাসপাতালে ছুটি। প্রায় মাসখানেক চিকিৎসায় সুস্থ হলেও তাঁর একপাশ অবশ, কথায়ও জড়তা। চিকিৎসাশাস্ত্র তখন এত আধুনিক ছিলনা, ফিজিওথেরাপিও না। কিছু করার ছিলনা বলে ছাড় করে দেয়া হয় প্রেসক্রিপশন দিয়ে। মন মানছিল না বলে ওনার চিকিৎসকের পরামর্শে সেনাবাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে সিএমএইচ এ ভর্তির ব্যবস্থা করি। প্রায় অবশ মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে আনার বাহন যোগাড়ে বিপদে পড়ি। সাংবাদিকতার পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় আগে থেকেই। আলহাজ্ব মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনও তখন আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে। তিনি বড্ডো স্নেহ করতেন। তাঁর ব্যবসায়িক অফিসে প্রায় হাজিরা দিতে হতো, কাজ শেষে। ক’দিন না যাওয়ায় তিনি দফায় দফায় ফোন করে খাতুনগঞ্জের মঈনুদ্দিন কর্পোরেশন এর অফিসে দেখা করতে বলেন। দেখা দেওয়ার পর বিষণ্ন মুখ দেখে মায়ের কথা জানতে চান। উত্তর দিতে ইতস্তত করায় বুঝে নেন, কোন বিপদ হয়েছে। তখন অ্যাম্বুলেন্স এত সুলভ ছিল না, পেলেও গ্রামে যেতে রাজি না। ওনাকে বলতে দ্বিধা হচ্ছিল, কারণ শুনলে তিনি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নেবেন। ঘটলোও ঠিক তাই। পীড়াপীড়িতে বলতে বাধ্য হই। সঙ্গে সঙ্গে নিজের চালককে ঢেকে এনে আমাকে বলেন, আপনি অফিসকে জানিয়ে এক্ষুণি গাড়ি নিয়ে চলে যান। আমি হতভম্ব! কী বলব ভেবে পাইনা। তিনি ইন্টারকমে অপারেটরকে আজাদীর নিউজে ফোন লাগাতে নির্দেশ দেন। কানেকশন পাওয়ার সাথে সাথে সেট ধরিয়ে দিয়ে অফিসকে জানাতে চাপ দেন। তাই করে চালকের সাথে পার্কিংএ চলে আসি। আশ্চর্য, তাঁর সদ্য কেনা নতুন টকটকে লাল টয়োটা স্টারলেট! নতুন মডেলের গাড়ির প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। তখন স্টারলেট সদ্য বাজারে এসেছে। এত আনকোরা গাড়িতে কীভাবে প্রায় অবশ রোগী তুলব! দোনমনা করে ফিরে অন্য গাড়ির কথা বলতেই মৃদু ধমক দিয়ে বলেন, “গাড়ি নষ্ট হোক-মাকে শান্তিতে আনুন”। এই লাইনটা আমার জীবনের সবচে’ দামি কোটেশন। তাঁর প্রিয় ঝকঝকে গাড়ির পেছনের নরম সিটে মাকে সিএমএইচে স্থানান্তর করি কোন ক্লেশ ছাড়াই।
মা মারা যান আরো তিন বছর পর ৮৮’র জুলাইতে। নাজিম ভাই ৯২এর ৩ জানুয়ারি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের ব্যবধান! এ’রকম আরো কত ঋণ, এই মহানুভব মানুষটির কাছে, স্মৃতির গর্ভে গুঁজে আছে। উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের প্রায় সব সাংগঠনিক কর্মসূচি, ঢাকার নেতাদের চট্টগ্রাম সফরের আপ্যায়ন, আবাসন, যাতায়াত প্রায় একাই টানতেন। এমনকী কেন্দ্র থেকে যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতারা আসলেও সব দায় তাঁর। নেত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম সফরকালীন সব কর্মসূচি সফলের দায়ও নাজিম ভাইয়ের। দলে আরো অনেক সম্পদশালী নেতা থাকলেও নাজিম ভাই একাই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। মাঠ কর্মীদের দেখভালও তিনি করতেন। কতজন যে তাঁর গোপন সহযোগিতা নিয়েছেন, হিসাব টানা দুঃসাধ্য। শিবির জা’পা, এনডিপি সশস্ত্র ক্যাডারদের হামলা পুলিশী নির্যাতনে দলের নিহত নেতা, কর্মীদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা এবং আহতের চিকিৎসার দায়ও হাসিমুখে বহন করতেন তিনি। এমন চওড়া কাঁধ ও নীরব মহানুভব নেতা আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে প্রায় বিরল বললে ভুল হবেনা। ভয়াল দুর্যোগের দিনে তিনিই ছিলেন হাটহাজারী তথা চট্টগ্রামের নির্যাতিত-নিপীড়িত অসংখ্য দলীয় নেতা, কর্মীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ের মূল ঠিকানা। শুধু দল নয়, তাঁর সহযোগিতার হাত সব দল ও মতের অসহায় ও নিপীড়িতকে স্পর্শ করেছে। চুপচাপ বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন। বারবার প্রতারণার শিকার হয়েও মুখে শিশুর স্মিত হাসি কেউ মুছে নিতে পারেনি তাঁর।
সমকালের এক অত্যাচার্য মানবব্রতী তিনি! চলে গেছেন অনুর্ধ মাত্র ৪০ বছর বয়সে। সর্বংসহা স্ত্রী, তিন প্রিয় শিশু সন্তান মনির, আনিস, মুন্নাকে ফেলে রেখে। ছোট কন্যা নাজমিন তখন মাতৃগর্ভে! প্রয়াণের পর দেখা যায়, রাজনীতি ও দাতব্য সেবার দায় মিটাতে দক্ষিণ খুলশীর বহুদামি প্রায় দু’একর জমিসহ প্রচুর স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছেন। এমন নীরব মানবপ্রেমী মহান নেতাটিকেও আওয়ামী লীগের চলমান ভোগবাদী রাজনীতি দ্রুত মুছে ফেলেছে। কিন্তু অতুলনীয় মানবপ্রেমের উজ্জ্বল আলো নাজিম ভাইকে নিশ্চিত আলোকিত করে রাখবে অনন্তকাল। ২৯তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে দুস্থ মানবতার ঠিকানা আলহাজ্ব মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের পবিত্র স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন বছরের প্রত্যাশা
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে