আজ দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রাউজান এলাকার সুলতানপুর গ্রামে জন্ম মোহাম্মদ আবদুল খালেকের। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই। সেদিন মা-বাবার কোল আলোকিত করে জন্মেছিল যে শিশুটি পরবর্তীকালে সেই চারাগাছটি মহীরূহ হয়ে উঠলো, চট্টগ্রাম অঞ্চল আলোকিত হয়েছিল তার আলোকচ্ছটায়। তাঁর জন্ম এমন একটা বিরুদ্ধ সময়ে, যখন ব্রিটিশ ভারতে এ পশ্চাদপদ চট্টগ্রামকে আগামীর পথে এগিয়ে নিতে আলোকিত মানুষের ভীষণ প্রয়োজন ছিল।
ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক একজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসনের ‘অন্ধকার সমাজে’ তিনি আলো জ্বালাতে দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষা সভ্যতায় চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তিনি এ পত্রিকাকে সামনে এনেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অন্ধকার দূর করে জাতিকে আলোকিত করতে যে পত্রিকার দরকার সেটা আজ থেকে ৬১ বছর আগে উপলব্ধি করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। এ কারণে তিনি একজন তড়িৎ প্রকৌশলী হয়েও সামাজিক প্রকৌশলী হিসেবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন সমাজের জাগরণ তথা রাষ্ট্রের উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য।
মোহাম্মদ আবদুল খালেক হলেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার, যিনি নিজের উজ্জ্বল পেশা ছেড়ে লাইব্রেরি, প্রেস ও পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে। তরুণ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেককে উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে। সমাজে জাগরণ, প্রগতিশীলতার চর্চা ও উন্নয়ন অগ্রগতি সর্বক্ষেত্রে দেশ, সমাজ ও দেশের মানুষকে যেভাবে তিনি দৈনিক আজাদীর মাধ্যমে ধারণ করেছেন তা বর্তমান সময়ে সকলের জন্য অনুসরণীয়।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রামের সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে নতুন গতি সঞ্চার করতে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আজাদী দৃঢ়ভাবে পালন করে এসেছে কল্যাণমুখী, মানবব্রতী ও দেশব্রতী ভূমিকা।
বস্তুনিষ্ঠতার তুলনায় দৈনিক আজাদী সত্যনিষ্ঠতার উপরই সর্বাধিক জোর দিয়ে আসছে শুরু থেকে। সেটা এখনো অব্যাহত আছে।
গরিব-দুঃখীদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের মুখে হাসি ফোটানো ছিল মোহাম্মদ আবদুল খালেকের আজীবনের সাধনা। বিত্ত ও চিত্ত এ দুটোকে সমন্বয় করে তিনি শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রেখে গেছেন। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের জ্যোতির্ময়ী চেতনা তরুণ সমাজে যতবেশি ছড়িয়ে দেওয়া যাবে, সমাজে ততবেশি আলোকিত প্রজন্ম তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তিনি জীবদ্দশায় নানাভাবে সমাজকে অকাতরে বিলিয়েছেন, সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ছিলেন সৃজনশীলতায় ভাস্বর মহাপুরুষ। তাঁর বহুমুখী কর্মযজ্ঞ এই ঘুণে ধরা সমাজে আলোর পথরেখা তৈরি করতে পারে। এ ভূখন্ডে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের মতো ব্যক্তিত্ব বহুমাত্রিক অবদান রেখে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি তিনি ছেপেছিলেন অসীম সাহসিকতায়।
মাতৃভাষার দাবিতে ঢাকায় শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে রচিত চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী রচিত কবিতাটি প্রথম ছাপানো হয় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার সূতিকাগার কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে। এ পুস্তিকাটি ছিল একুশের প্রথম সংকলন। এভাবেই সংবাদপত্রের ভূমিকা দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে শুধু সোচ্চার হয়নি, মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে এবং নৈতিকতা অনুসন্ধানে উজ্জীবিত করেছে। স্বল্পপরিসরে সংবাদপত্র ও তাদের সংবাদ পরিবেশনকে ঘিরে নির্যাতন-নিপীড়নের ইতিবৃত্ত রচনা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তবুও অল্পকিছু সমাজ-ইতিহাস পর্যালোচনায় সংবাদপত্র সমূহের উজ্জ্বল অবদান সহজেই অনুমেয়।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার শুধু লেখক তৈরি করেন নি, তিনি নিজে অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে রয়েছে : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন, শেখ এ চাটগাম কাজেম আলী, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ১৯৩০, বার আউলিয়া, নেপোলিয়ান, প্রাথমিক ভূগোল, বিজ্ঞান ও গ্রাম্য জীবন, রচনার প্রথম ছড়া, উর্দু প্রাইমার, বয়েস ইংলিশ গ্রামার, ফাস্ট বুক অব ট্রান্সলেশন, চাইল্ড পিকচার ওয়ার্ড বুক, ব্যাকরণ মঞ্জুষা, তাওয়াফ (হজ্বের বই), ঝলমল (শিশুপাঠ), মুসলিম বাল্য শিক্ষা, সহজ পাঠ (শিশুপাঠ্য) ইত্যাদি। ক্ষণজন্মা পুরুষ, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব, সমাজ হিতৈষী এবং দেশের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তাঁর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে আগামী প্রজন্ম পেতে পারে কাঙ্ক্ষিত পথনির্দেশনা।