ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক বাসায় এক নারী ও তার কিশোরী মেয়েকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে শাহজাহান রোডে রেসিডেন্সিয়াল কলেজের উল্টা পাশের একটি আবাসিক ভবনের সপ্তম তলার বাসায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
নিহত লায়লা আফরোজের বয়স ৪৮ বছর। তিনি গৃহিণী। আর তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজের বয়স ১৫ বছর। সে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের একজন এসআই বলেন, লায়লার স্বামী এ জেড আজিজুল ইসলাম উত্তরার একটি স্কুলের শিক্ষক। সকালে তিনি বাইরে গিয়েছিলেন। সাড়ে ১০টার দিকে বাসায় ফিরে স্ত্রী–কন্যার লাশ দেখতে পান বলে পুলিশকে বলেছেন। খবর বিডিনিউজের। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ–কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, আমরা দুটি লাশ একসঙ্গে পেয়েছি। ঘটনার পারিপার্শ্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
হত্যায় গৃহকর্মী! : মা–মেয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশ এক তরুণীকে সন্দেহ করছে, যিনি মাত্র চারদিন আগে অস্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে সেখানে কাজ নিয়েছিলেন। আয়েশা নামের ওই তরুণী গতকাল সকালে কাজে এসেছিলেন বোরকা পরে। দেড় ঘণ্টা বাদে বেরিয়ে যান স্কুলড্রেস পরে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে।
মাঝের সময়টিতে ওই বাসায় খুন হন মা–মেয়ে। পরে খবর পেয়ে ওই বাসা থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বাসাটির অবস্থান শাহজাহান রোডে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিপরীত পাশের আবাসিক ভবনের সপ্তম তলায়।
কিশোরীর বাবা এ জেড আজিজুল ইসলাম উত্তরার সানবিমস স্কুলের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাকে নিয়ে ওই বাসায় প্রায় ১৩ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন তিনি। তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোরে। প্রতিদিনের মতো গতকাল সকাল ৭টার দিকে স্কুলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে যান আজিজুল। স্কুলে পরীক্ষা চলমান থাকায় বাসায় ফেরেন তাড়াতাড়ি। বেলা ১১টার দিকে বাসা এসে তিনি স্ত্রী–কন্যার লাশ দেখতে পান। পরে তার চিৎকারে আশেপাশের বাসিন্দারা বেরিয়ে আসেন, খবর দেওয়া হয় পুলিশে।
ভবনের একাধিক সিসিটিভি ভিডিও বিশ্লেষণ করে পুলিশ বলছে, সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে বোরকা পরে ওই বাসায় ঢোকেন আনুমানিক ২০ বছর বয়সি আয়েশা। আর ৯টা ৩৬ মিনিটে স্কুলড্রেস পরে নির্বিঘ্নে বাসা থেকে বেরিয়ে যান। ওই স্কুলড্রেসটি ছিল খুন হওয়া নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাফিসার। ওই বাসা থেকে পুলিশ দুটি ধারালো ছুরি উদ্ধার করেছে। হত্যাকারী ঘটনার পর বাসার বাথরুম ব্যবহার করেছেন, এমন আলামত পাওয়ার কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এখন পর্যন্ত খুনের ঘটনায় সন্দেহভাজন ওই গৃহকর্মীরই জড়িত থাকার বিষয়টি ধারণা করে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার ইবনে মিজান বলেছেন, ঘটনার আগে–পরে ওই বাসায় একজনের আসা যাওয়াই দেখা গেছে। সিসি ক্যামেরা ফুটেজে আমরা একজনই দেখেছি। পরে দেখব আশেপাশে আরও কেউ ছিল কিনা। পরে জানতে পারব তার সাথে আশেপাশে কেউ ছিল কিনা।
সরেজমিনে ওই বাসাটিতে গিয়ে দেখা যায়, লিফটের সামনে থেকে বাসার দরজা পর্যন্ত ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দরজা খুলতেই বাসায় আসবাবপত্র এলোমেলো অবস্থায় দেখা গেছে। বাসার ভেতরের অবস্থার বিষয়ে পুলিশ বলছে, বাসায় ধস্তাধস্তির আলামত রয়েছে, মেঝেতে ও দেয়ালে রক্তের দাগ রয়েছে। আলমারি ও ভ্যানিটি ব্যাগ তছনছ অবস্থায় রয়েছে। এ থেকে তাদের ধারণা, বাসা থেকে কিছু খোয়া যেতে পারে।
এদিকে গৃহকর্তা আজিজুল বাসায় এসে প্রথমে দরজায় নক করে কোনো সাড়াশব্দ পাননি, এরপর দেখতে পান দরজা খোলা। তিনি প্রবেশ করে ড্রইংরুমে মেয়ে নাফিসার রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেন এবং পাশের রুমে একটু দূরে স্ত্রীর রক্তাক্ত দেহ দেখতে পান।
বেঁচে থাকতে পারে ধারণা করে অন্যান্য প্রতিবেশীদের সহায়তায় মেয়েকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন আজিজুল, সেখানে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। আর পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে লায়লা আফরোজের লাশ উদ্ধার করে। লাশ দুটির সুরতহালের পর ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছে। দুজনের শরীরেরই একাধিক স্থানে এলোমেলো ছুরিকাঘাতের চিহ্ন থাকার কথা বলেছে পুলিশ।
আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের একজন কাজের মহিলার দরকার ছিল। সাধারণত গেটে অনেকেই কাজের সন্ধানে আসেন। আমরা দারোয়ানকে এমন কেউ আসলে জানানোর কথা বলে রেখেছিলাম। ৪ দিন আগে একটি মেয়ে কাজের সন্ধানে আসে। বোরকা পরিহিত অবস্থায় ওই মেয়েটি আসলে দারোয়ান তাকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়৷ এরপর আমার স্ত্রী মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে কাজে রেখে দেয়। পরে আমি স্ত্রীর মুখে শুনেছি, মেয়েটার নাম আয়েশা। আয়েশা তাদেরকে জানিয়েছে, তার গ্রামের বাড়ি রংপুর, জেনেভা ক্যাম্পে চাচা–চাচির সঙ্গে থাকেন। বাবা–মা আগুনে পুড়ে মারা গেছে, তার শরীরেও আগুনে পোড়ার ক্ষত রয়েছে বলে জানিয়েছিল। স্থায়ী গৃহকর্মী না হওয়ায় তার কোনো কাগজপত্র রাখা হয়নি বলে জানান আজিজুল। তিনি জানান, কাজ শুরুর পর প্রথম দুদিন সময় মতোই এসেছে, রোববার এসেছিল সাড়ে ৯টার দিকে।
ঘটনার পর দারোয়ান খালেককে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তিনি পুলিশকে বলেছেন, ৪ দিন আগে বাসায় কাজের জন্য আসায় তরুণীকে ওই ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওই তরুণী তার পূর্বপরিচিত নন। ভিডিও ও দারোয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ বলছে, গতকাল সকাল ৭টার পর যখন ওই বাসায় যাওয়ার জন্য আসে, স্বাভাবিকভাবেই বাসার নিরাপত্তাকর্মী খালেক তাকে ভেতরে যেতে দেন। কিন্তু বের হওয়ার সময় স্কুলড্রেস পরে যাওয়ার সময় তার মুখে মাস্ক থাকায় গেটে দায়িত্বরত থাকা খালেক চিনতে পারেননি।
তারপরেও গেট থেকে বের হওয়ার পর তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সপ্তম তলার ‘৭বি’ ফ্ল্যাটে থাকেন বলে চলে যান। সেটি আজিজুলেরই ফ্ল্যাটের নম্বর, সেখানেই গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছিলেন আয়েশা।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ–কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে কিছু তথ্য পেয়েছি, সেসব যাচাই বাছাই চলছে। গৃহকর্মীর প্রসঙ্গে করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ঘটনার সঙ্গে তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কাজ করছি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি, হত্যার আগে পরে তার উপস্থিতি ও অ্যাকটিভিটিজ বিশ্লেষণ করে পরবর্তী তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাব।












