‘দুঃসময়ের আঁধার ভেঙে/ সুসময় আজ দিচ্ছে ডাক; সিআরবির প্রেতাত্মারা/ চাটগাঁ থেকে নিপাত যাক’-এমন শ্লোগানে মুখর সিআরবির সাত রাস্তার মোড়।
দিনের আলো নিভছে তখন, জ্বলে উঠছে মোমবাতি। সাথে বুকের ভেতর পুষে রাখা বারুদ তো রয়েছেই। আর কী চাই? আপন শক্তিতে বলীয়ান তারুণ্যকে রুখবে এমন সাধ্য কার? শুধু কি তরুণ, নানা বর্ণের নানা পেশার দল মত গোত্র ভেদে সকলের গন্তব্য একটাই ‘সিআরবি’। অন্যায়ের সাথে কখনো আপস করে না চট্টগ্রামবাসী। প্রয়োজনে জ্বলে উঠে আপন শক্তিতে। প্রতিবাদে কখনো তারা নিশ্চুপ হয়ে যায়, কখনো আলোকের ঝর্ণাধারায় নতুন শপথে হয় বলীয়ান। সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগের প্রতিবাদে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের আয়োজনে আলোচনা সভা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেনও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, সিআরবিতে কোনোভাবেই হাসপাতাল হতে দেয়া হবে না। সিআরবিতে হাসপাতাল না করার দাবিটি পুরো চট্টগ্রামের। সঠিক বার্তাটি প্রধানমন্ত্রীকে পৌঁছানো গেলে তিনি আমাদের কথা শুনবেন।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, এই শহরে যেসব প্রাকৃতিক সুন্দর ঐতিহ্যপূর্ণ জায়গা ছিল কোনোটিই এখন আর নেই। এমনকি যে পরীর পাহাড় বা কোর্ট বিল্ডিং, এক সময় সেখানে উঠলে কর্ণফুলী নদী যে চট্টগ্রাম শহরকে বেষ্টন করে রয়েছে তা দেখা যেত। আজকে কিছুই দেখা যায় না। চট্টগ্রাম গাছ শূন্য হয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন জঙ্গলকে রক্ষায় বিশ্বের অনেক দেশ অর্থ দিয়ে যাচ্ছে, কারণ বিশ্বের অঙিজেনের চাহিদা মেটায় আমাজন। ঠিক সেরকম এই সিআরবিতে অসংখ্য শতবর্ষী গাছ রয়েছে। এই পুরো অঞ্চলটাই মহানগরীর শ্বাস কেন্দ্র।
তিনি বলেন, এখানে রয়েছে শহীদ আবদুর রবের বাসা। এই শহীদ আবদুর রবের সাথে ১৯৭১ সালের এপ্রিলে কানুনগোড়ায় দেখা হয়েছিল। তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস। আমি বলেছিলাম, রব তুমি সাবধানে চলাফেরা করো। শহরে যাচ্ছ বলছো, সাবধানে যেও। সে আমাকে বলেছিল, স্যার আপনি সাবধানে থাকবেন। দু:খের বিষয় সেই রব শহীদ হয়েছিল। সেই শহীদের জায়গা এই সিআরবি। এইখানে কখনোই প্রফিটের জন্য আমরা হাসপাতাল করতে দিতে পারি না। বাংলাদেশের সবাই জানেন, এই হাসপাতালটি কী রকমভাবে মৃত মানুষ গেলেও অর্থ আদায় করে। এই চমৎকার জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল করতে আমরা কখনোই দেব না। এটিকে ধ্বংস করতে দেব না। তরুণ প্রজন্ম দেবে না। আমরা যদিও বৃদ্ধ হয়েছি, আমরাও দেব না। আমরা সবাই মিলে প্রতিহত করব। প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতি সচেতন এবং তিনি মানুষের কথা সবসময় ভাবেন। তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছে। তাঁকে যথাযথ বার্তাটি দিতে পারলে তিনি নিশ্চয় আমাদের কথা শুনবেন। এই আমলা বা রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা তাঁকে ভুল বুঝিয়েছেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হব। আমরা প্রতিজ্ঞা করছি এখানে এই হাসপাতাল হতে দেব না। প্রয়োজনে অনশন থেকে শুরু করে যা কিছু করার সবকিছু আমরা করব।
নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশ নেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাস আমিন, প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দিন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফফর আহমদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুচ, নাট্যজন-সাংবাদিক প্রদীপ দেওয়ানজী, পরিবেশবিদ ড. ইদ্রিস আলী, মহানগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, পিপলস ভয়েস সভাপতি শরীফ চৌহান, ন্যাপ নেতা মিঠুল দাশগুপ্ত, আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী, দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবর, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাবু, শিল্পী আলাউদ্দিন তাহের, আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মনসুর, যুব নেতা নূরুল আজিম রনি।
নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের সদস্য ও বোধনের সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরীর সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী।
গতকাল ছিল গণজমায়েতের সপ্তম দিন। দিন যতো এগুচ্ছে, আয়োজকদের ভুল প্রমাণ করে বাড়ছে জনসমাগম। বন্ধুদের আড্ডা আর পাড়ায় নয়, জমছে এখানে। খেলার মাঠে নয়, মায়ের হাত ধরে সন্তান আসছে সিআরবিতে। প্রিয়জনের সাথে একান্তে কথা বলতে কফিশপ নয়, আসছে দুজনে সিআরবিতেই। এভাবে রাজনৈতিক আলাপচারিতা থেকে নিত্যদিনের গালগল্প সবকিছুই এখন সিআরবিমুখী। আর গল্পের ফাঁকে, প্রিয়জনের সাথে অভিমানের মাঝে শ্লোগান ধরছে কেউ, কারো কন্ঠে উঠে আসছে গান। আত্মার বন্ধনে মিলেছে সবাই, প্রতিবাদ প্রতিরোধের এ চেতনা অবচেতন ভাবেই ধ্বনিত হচ্ছে জনতার কন্ঠে। জনতার স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ এটি।
সিআরবির সাত রাস্তার মোড়ে সন্ধ্যায় অনেকের সাথে যোগ দেন সিইপিজেডেএর পোশাক শ্রমিক ইউছুফ। তিনি বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আসবো প্রতিদিন।
স্কুল ছাত্রী মিতা, শ্যামা, আফরোজা ও বিন্তি এসেছে বিকেলে সিআরবিতে। বিন্তি বলে, মানুষের জীবন তো সবসময় একভাবে যায় না। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে আমাদের বয়সী অনেকেই মিছিল সমাবেশে অংশ নিয়েছে। আমাদের সেই সুযোগ হয়নি। তাই সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। আমরা বুক ভরে শ্বাস নিতে চাই।
সন্ধ্যা গড়াতেই জ্বলে ওঠে মোমবাতি। তার আয়োজন চলে বিকেল থেকেই। আঁধার ঘনালে অন্যরকম আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। সন্ধ্যায় আলোক প্রজ্জ্বলনের সময় সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী চট্টগ্রামের শিল্পীরা। সিআরবিকে রক্ষায় স্বরচিত কবিতা পাঠ করে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী মিম্বর হুরে জান্নাত। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন শেষে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় চট্টগ্রাম যন্ত্র শিল্পী সংস্থার আয়োজনে।
নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক শুকলাল দাশ, ঋত্বিক নয়ন, রমেন দাশগুপ্ত, মহররম হোসেন, আমিনুল ইসলাম মুন্না, পার্থ প্রতিম বিশ্বাস, রাহুল দত্ত, মিনহাজুল ইসলাম, সব্যসাচী টিটু, বিনয় ভৌমিক ও সৌরভ দাশ। আজ বিকেল চারটায় সিআরবিতে অষ্টম দিনের মতো প্রতিবাদী সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম।












