এক দশক আগে যখন মোবাইল ফিন্যান্সিয়ালসার্ভিস (এমএফএস) যাত্রা শুরু করেছিল, তখন দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় একটি পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছিল। ব্যাংকিং সেবার আওতাবহির্ভূত মানুষেরা যারা বেশির ভাগই প্রত্যন্ত এবং দুর্গম এলাকার অধিবাসী, আর্থিক খাতের এই অন্তর্ভুক্তির প্রাথমিক সুফল তারাই পেয়েছিল। এমনকি একটি খুব সাধারণ এবং অতীতপ্রজন্মের সেলুলার ফোনের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করার সুযোগ পেয়ে তারা নিজেদের প্রয়োজন সহজে মেটাতে সক্ষম হয়েছিল। শুরুরদিকে এই সেবার আওতা প্রধানত অর্থ প্রেরণ এবং গ্রহণ করার মধ্যেই সীমিত ছিল। এই লেনদেন সহজে সম্পাদনের প্রক্রিয়ায় কয়েক হাজার তরুণের নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। টেলিফোনিক কথোপকথন করার জন্য সহজ সেলুলার ফোনটি তখন আর একটি নিছক যন্ত্র ছিলনা, এটি একটি ব্যাংকিং উপকরণে পরিণত হয়েছিল।
দশ বছরে এই সেবা ডানা মেলেছে এবং মানুষের আর্থিক লেনদেন সহজ করেছে। এখন এই পরিষেবা, অর্থ প্রদান, স্কুলের ফি, রেল, বাস, লঞ্চ এবং এয়ারলাইন গুলির জন্য টিকিট কেনা এমন কি মুদি দোকানের বিল নিষ্পত্তির মতো আর্থিক লেনদেনের অন্যতম উপায় হয়ে উঠেছে। আজ যে কেউ আঙুলের স্পর্শে এই লেনদেন গুলি করতে পারে এবং ব্যাংক পরিষেবাগুলো আমাদের হাতের তালুতে রয়েছে বলে মনে হয়।
এখনকার দিনে মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন ব্যাপক পরিবর্তিত হয়েছে এবং মানবসমাজের জীবন কাঠামোতে নিজের অবস্থান এমন শক্তিশালী করেছে যে, খুব শীঘ্রই বা নিকট ভবিষ্যতে আমাদের জীবন নগদহীন হবে। এখন ইচ্ছা করলে যে কেউ নগদহীন জীবনযাপন করতে পারেন। কোভিড ১৯ মহামারীর সময় যখন জীবন স্থবির হয়ে পড়েছিল তখন পুরো দৃশ্যপটটি আরো পরিষ্কার হয়েছিল, আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি, যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ জীবনের চাকা সচল রাখতে পারে। যা ই-কমার্স নামে পরিচিত, তা অসাধারণ গতিতে বেড়েছে কারণএমএফএসএর মেরুদন্ড হিসেবে কাজ করেছে।
এখন যেহেতু এমএফএস জনগণের বিশাল আস্থা অর্জন করেছে, এটি আজ সাধারণ ব্যাংকিং লেনদেনের চেয়ে বেশি কার্যকরী, যদিও তাবড় অঙ্কের জন্য নয়। এটা আরও গুরুত্বপূর্ণ কেননা, এমএফএস সমাজের দরিদ্র অংশের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে যাদের ব্যাংক হিসাবের মালিক হওয়ার যোগ্যতা নেই বা এমনকি যাদের যোগ্যতা আছে কিন্তু কাছের ব্যাংক পর্যন্ত পৌঁছাতে অসুবিধা রয়েছে। সুতরাং, এমএফএস তাদের জন্য একটি মুক্তি, নিঃসন্দেহে যে কারোর জন্যই তাই।
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বাংলাদেশে ঋণ সুবিধা চাল ুকরার সাথে সাথে একটি নতুন প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে। সিটি ব্যাংক লিমিটেড এক বছর আগে একটি পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু করে। হ্যাঁ, এই পদক্ষেপটি সাধারণ মানুষের জীবনে, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেবার বাইরের দরিদ্রদের জীবনে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাতে সফল হয়েছে। “ন্যানো লোন” হিসাবে পরিচিত, এটি মূলত এমএফএস প্রদানকারী বিকাশের একটি ডিজিটাল মাইক্রো লোন উদ্যোগ। যুগান্তকারী উদ্যোগটি গ্রাহকদের, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেবার বাইরের জনগণকে, একটি নির্ধারিত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে অপেক্ষাকৃত কম সুদ হারে মোবাইলওয়ালেটের মাধ্যমে ঋণ নিতে সক্ষম করেছে। তারা ডিজিটাল ক্রেডিট অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে এই ঋণ পেতে পারে এবং সহজে দীর্ঘ ঋণ প্রক্রিয়ার ঝামেলা এড়াতে পারেন।
যাইহোক, সবচেয়ে বড় সুবিধাযা এই নতুন প্রয়াসের কারনে সম্ভব হয়েছে সেটি হলো, দরিদ্র এবং ছোট ব্যবসায়ীর বা এমনকি যাদের একটি বিকাশ হিসাব রয়েছে, তাদের তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম করে যার পরিমাণ ৫০০ থেকে টাকা ১০০০ পর্যন্ত। পরবর্তীতে কিস্তিতে এই টাকা পরিশোধের সুবিধা রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ঐতিহ্যগত দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করার কোন ঝামেলা ছাড়াই এবং এটি জামানত মুক্ত হওয়ায়, এটি প্রকৃতপক্ষে আরও একটি সাহসী পদক্ষেপ যা ব্যাংকবহির্ভূত মানুষকে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম করবে।
এই উদ্যোগ একটি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ জন্য সরকারের যে লক্ষ্য রয়েছে তার একটি বড় মাইলফলক, যেখানে একটি নগদহীন সমাজ, অর্থনৈতিক ভেদাভেদ নির্বিশেষে সকলের আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তি, তাৎক্ষণিক লেনদেনের ক্ষমতা, আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা দূরীকরণ এবং সর্বোপরি, সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করছে।
ব্যাংক ও বিকাশ সূত্রে জানা গেছে, ন্যানো লোন সুবিধা ব্যাপক সাফল্য ও ইতিবাচক সাড়া পেতে শুরু করেছে।এমনকি মধ্যরাতে বা ছুটির দিনেও জরুরি আর্থিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার পাশাপাশি, এই সুবিধাটি সত্যিকারের বিশ্বস্ত বন্ধ হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে যাকে যে কোন সময় পাশে পাওয়া যায়। একজন দরিদ্র ব্যবসায়ী বা কৃষক যে কোন সময় তার সামান্য অর্থের জরুরী প্রয়োাজন মেটাতে এর চেয়ে বড় সাহায্য আর কি হতে পারে? ঋণ পরিশোধের সুবিধাগুলিও উপযুক্ত যা ঋণ গ্রহীতার জীবনকে সহজ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, নতুন এই উদ্ভাবনী পরিষেবাটি আমাদের সমাজের একটি বড় অংশের জন্য স্বস্তির জোয়ার এনেছে যারা সব সময় আর্থিক কার্যক্রমের মূলধারা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে। এটি এখন তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের নীরব সুযোগ দিচ্ছে যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর মাধ্যমে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করার যাত্রা শুরু হয়েছে এবং সঠিক পথে রয়েছে। বিকাশ যখন পথ দেখিয়েছে অন্যান্য প্রদানকারী যেমন ট্যাপ, নগদ, এম-ক্যাশ, উপায় সেই পথ অনুসরণ করছে। লক্ষ লক্ষ লোককে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে সকলেই কাজ করে চলেছে।
সদ্য চালু হওয়া‘ন্যানো লোন; জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরেকটি কার্যকর বুস্টার হতে পারে। স্পষ্টতই দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করবে এই লোন যা সর্বদা যে কোনো জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।