প্রতি প্রান্তিকেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ; সবশেষ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে তা সাড়ে ৭৪ হাজার কোটি টাকা বা ২২ শতাংশ বেড়ে দেশের ইতিহাসে প্রথমবার ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, মার্চ প্রান্তিক শেষে দেশের মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় এক চতুর্থাংশই (২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ) এখন খেলাপি ঋণ। এক বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালের মার্চ প্রান্তিকের চেয়ে এ বছরের মার্চে বেড়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকার বেশি (১৩০ দশমিক ৫৭ শতাংশ)। খবর বিডিনিউজের।
সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ সময়ে ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। ডিসেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। আর এক বছর আগে ২০২৪ সালের মার্চে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র ও পরিচালক শাহরিয়ার সিদ্দিক সাংবাদিকদের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ তথ্য দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলছেন, খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে নীতি পরিবর্তনের কারণেই এ পরিসংখ্যানে উল্লম্ফন হয়েছে। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ হিসাবের মেয়াদোত্তীর্ণের সময় আগে ছিল ১৮০ দিন। সেটা ৯০ দিন ধরে হিসাব করা হচ্ছে। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।
মার্চের আগের প্রান্তিক ডিসেম্বরে আগের তিন মাসের চেয়ে এক লাফেই বেড়েছিল ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। এর আগের প্রান্তিক সেপ্টেম্বরে তার আগের তিন মাসের ব্যবধানে বেড়েছিল প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরীও মনে করছেন, মেয়াদোত্তীর্ণের ঋণের সময় কমানোর কারণেই ব্যাংকখাতের আসল ক্ষত বেড়িয়ে আসছে, যা সরকারের সময়েই তৈরি হয়েছে।
এর আগে নীতি পরিবর্তনের কারণে যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যে বাড়বে সেই আভাস আগেই দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
কোন ধরনের ব্যাংকে খেলাপি ঋণ কত? : বরাবরের মতো এবারও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ার তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ব্যাংক থেকে দেওয়া ঋণের বড় অংশ ফেরত না আসায় খেলাপি ঋণে প্রতি প্রান্তিকেই রেকর্ড হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ৪৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ডিসেম্বর প্রান্তিকে ছিল যা ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মার্চ শেষে টাকার অংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। এ প্রান্তিক শেষে মোট ঋণ বিতরণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা।
অপরদিকে মার্চ প্রান্তিক শেষে বেসরকারি ব্যাংকে মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ১৬ শতাংশ। ডিসেম্বরে যা ছিল ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। মার্চ প্রান্তিকে টাকার অংকে বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। মোট ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৩ লাখ ১০ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা।
মার্চ শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। মার্চ প্রান্তিকে মোট বিতরণ করা হয়েছে ৬৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা। আর মার্চে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এ সময়কালে ঋণের স্থিতি ছিল ৪৪ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা।
আরও যেসব কারণ দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক : মার্চ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের রেকর্ড আরও বেড়ে যাওয়ার পেছনে পাঁচটি প্রধান কারণ তুলে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মেয়াদী ঋণের মেয়াদোত্তীর্ণের সময় পুনর্নির্ধারণ ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগের কতিপয় গ্রাহকের বড় অংকের ঋণ বিরূপমানে শ্রেণিকৃত করা, গ্রাহকের চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতফসিল করা ঋণের কিস্তি যথাসময়ে পরিশোধিত না হওয়া এবং বিদ্যমান বিরূপমানে শ্রেণিকৃত ঋণ হিসাবের বিপরীতে সুদারোপ।