সড়ক–মহাসড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর একটি বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া চালনা, মাত্রাতিরিক্ত গতি, আইন না মানা এবং চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা। লাইসেন্স বা দক্ষতা অর্জন ছাড়াই রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে বের হচ্ছেন অনেকে। বেপরোয়া গতি ও হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতা বাড়াচ্ছে প্রাণহানি। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুব সমাজ। এখন যত মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় মোটরসাইকেল আরোহীদের। চলতি বছর চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশে সংঘটিত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো নিয়ে বুয়েটের বিশ্লেষণ বলছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি হচ্ছে পেছন থেকে ধাক্কায়। মোট দুর্ঘটনার ৪২ শতাংশই অন্য যানবাহন মোটরসাইকেলকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার ফলে ঘটছে। একইভাবে ১৪ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে মুখোমুখি সংঘর্ষে। আরো ১৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে পথচারীকে ধাক্কা দিয়ে। অন্যদিকে ওভারটেক করতে গিয়ে ১০ শতাংশ, সংঘর্ষে ৯ শতাংশ, সড়কের কোনো অবকাঠামোর সঙ্গে ধাক্কা লেগে ৩ শতাংশ, পার্ক করে রাখা যানবাহনকে ধাক্কা দিয়ে ২ শতাংশ ও ৬ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে অন্য কারণে।
বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণে বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল ও ভারী যানবাহন চালানো, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে চট্টগ্রামের সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা থামছে না। ফলে মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি রোধ করা, ট্রাফিক আইন কড়াকড়ি করা ও সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে দুর্ঘটনা কমাতে হবে। সড়ক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরসাইকেল ও ভারী যানবাহন চট্টগ্রামের রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। কার আগে কে চালাবে, এমন একটা প্রতিযোগিতা থাকে। চালকদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের সড়কগুলো পথচারী বান্ধব নয়। বেশির ভাগ ফুটপাত অবৈধ দখলে; যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে মূল সড়ক দিয়ে হাঁটতে বাধ্য হন পথচারীরা। এ ছাড়া ছোট আকারের যানবাহনগুলো যেনতেনভাবে চলাচল করে।
দুর্ঘটনা কমাতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি; চালকদের বেতন–কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা; পরিবহন মালিক–শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে, এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা তৈরি করা। জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সারা দেশে সড়কের যে বিশৃঙ্খল অবস্থা, চট্টগ্রাম তার বাইরে নয়। চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও অনেক অপ্রশস্ত সড়ক রয়েছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে সংগঠনের সুপারিশগুলো যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি জানাই।
এদিকে সারাদেশের সড়কে কোন গাড়ি সর্বোচ্চ কত গতিতে চলতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু একই সড়কে বিভিন্ন ধরনের গাড়িকে ভিন্ন গতিতে চলতে বলা হয়েছে। লেনভিত্তিক গতি আলাদা করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এতে সড়কে শৃঙ্খলা না ফিরে বরং গতির ভিন্নতার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন সড়কে সবচেয়ে আলোচিত মোটরযান মোটরসাইকেল চালানোর গতি সড়কের মান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা সদর ও শহর এলাকায় মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। একইভাবে যাত্রীবাহী গণপরিবহন, পণ্যবাহী যান, ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রে গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার জরুরি পরিস্থিতিতে সব গাড়ির ক্ষেত্রে আইন শিথিল থাকবে। পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, গতি কমালে দুর্ঘটনা কমবে, কিন্তু এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। উল্টো লেনভিত্তিক গতি আলাদা না করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে। দেশে এঙপ্রেসওয়ের মতো মহাসড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ হচ্ছে শুধু চলার গতি বাড়ানোর জন্য। এমনকি গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশে ৩৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। একদিকে উচ্চগতির বাহন আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে যানের গতি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
চলতি বছর চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় শুধুমাত্র মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার (১০ মে) রাত ৯টার দিকে বায়েজিদ লিংক রোডে কাভার্ড ভ্যানের সাথে মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে রাহুল সাহা নামে এক যুবক নিহত হন। বেলা ১১টার দিকে মীরসরাইয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাসের সঙ্গে লেগে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে হাফেজ সাইফুল ইসলাম (৪০) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন। ৪ মে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা থানাধীন খেজুরতলা এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক পথচারী নিহত হয়েছেন। ২২ এপ্রিল চট্টগ্রামে কাপ্তাই সড়কের সেলিনা কাদের চৌধুরী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় বাস–মোটরসাইকেল সংঘর্ষে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন আরও একজন। ১৮ এপ্রিল চকরিয়ায় চট্টগ্রাম–কঙবাজার মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে রিয়াজ উদ্দীন (২৩) নামে এক কলেজ ছাত্র নিহত হয়েছেন। ২৭ এপ্রিল দোহাজারী এলাকায় বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে গুরুতর আহত হন মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম রাকিব (২৫)। ১২ দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ৯ মে তার মৃত্যু হয়। ১৩ এপ্রিল ফটিকছড়ির নাজিরহাটে মারা গেছেন দুই মোটরসাইকেল আরোহী। ১২ এপ্রিল বিকাল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম–কঙবাজার সড়কের পটিয়া উপজেলার মনসার টেক মেম্বারের দোকানের সামনে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। ২ এপ্রিল রাউজানে সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে মোটরসাইকেল আরোহী হাফেজ মুহাম্মদ ছৈয়দুল হক নামের এক ইমাম ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে। অপর মোটরসাইকেল আরোহী হাফেজ মুহাম্মদ আলী হোসাইন মুমূর্ষু অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ১৬ মার্চ সীতাকুণ্ডে দ্রুতগামী গাড়ির ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও একজন। ১৪ মার্চ সাতকানিয়ায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাহার উদ্দিন (৪৮) নামের এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি ফটিকছড়িতে পিকআপ–মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে হাফেজ ফয়েজ আহমদ নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। বোয়ালখালীতে দুই বাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত মো. ইমরান উদ্দিন আরমান (২৩) ১৩ ফেব্রুয়ারি নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিসি পার্ক সংলগ্ন ট্রাংক রোডে লরির আঘাতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার নিহত হন রায়হান নামে এক যুবক। ২২ জানুয়ারি লোহাগাড়ায় ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মোটরসাইকেলের তিন আরোহী নিহত হয়েছেন। ১২ জানুয়ারি বোয়ালখালীতে মোটরসাইকেল যোগে বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পথে কালভার্টের সাথে ধাক্কা লেগে আবদুল্লাহ আল হোসাইন (২০) নামে এক তরুণ নিহত হয়েছেন।