বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। আর বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার ৩৯ শতাংশই মোটরসাইকেলের কারণে হয়েছে। এর পেছনে অবৈধভাবে লাইসেন্স পাওয়া, লাইসেন্স ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া চালানো আর ঝূঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল চালানোকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত জুলাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় সংঘটিত ৭৩১টি যানবাহনের পরিচয় মিলেছে। এতে দেখা যায়, ২৫.৯৯ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২২.৮৪ শতাংশ ট্রাক–পিকাপ–কাভার্ডভ্যান ও লরি, ১৮.৭৪ শতাংশ বাস, ১৫.৩২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক, ৫.৭৪ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ৪.৫১ শতাংশ নছিমন–করিমন–মাহিন্দ্রা–ট্রাক্টর ও লেগুনা, ৬.৮৩ শতাংশ কার–জিপ–মাইক্রোবাস সড়কে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ মাসে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩৮.৬১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩০.৬৯ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৪.১৫ শতাংশ ফিডার রোডে হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে মোট দুর্ঘটনার ৫.৩৪ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০.৩৯ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ০.৭৯ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।
গত ৬ নভেম্বর দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক–মহাসড়কে বেপরোয়া গতিতে চলা মোটর সাইকেলগুলো এখন ভয়াবহ আতঙ্ক। দেশে অনিরাপদ সড়ক আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে পাল্লা দিয়ে মাঠে নামা এই দুই চাকার যানটি। গবেষণায় উঠে এসেছে, মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তা বিশ্বে সর্বোচ্চ। দেশে দু’চাকার এ যানটির উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় দাম যেমন কমেছে, সহজে মিলছে নিবন্ধন, তেমনি পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুও যেন সহজ হয়ে উঠেছে। লোনে, কিস্তিতে বা সামান্য টাকা হলেই মোটরসাইকেল কিনতে পারছে যে কেউ। কিন্তু তাতে যে মৃত্যুঝুঁকি কত বাড়ছে– সেটা যেন কেউ চিন্তা করছে না। সর্বশেষ গত শনিবার একদিনেই নগরী ও জেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন সাত জন এবং আহত তিনজন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) উপ–পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক–পশ্চিম) তারেক আহমেদ আজাদীকে বলেন, নগরীতে রাস্তার ট্রাফিক ঘনত্বের অবস্থা বুঝে যানবাহনগুলো ঘণ্টায় ৩৫ থেকে ৪৫ কিলোমিটার বেগে চালাতে পারে। কিন্তু গতির ক্ষেত্রে অনেক সময় নিয়ম মানতে দেখা যায় না। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর বর্তমান জনসংখ্যার তুলনায় সড়কের সংখ্যা কম। অন্যদিকে যানবাহনের সংখ্যা সড়কের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এখানে যানবাহনের শৃঙ্খলা রক্ষায় ধীরগতির রিকশাসহ অন্যান্য দ্রুতগতির যানবাহনের জন্য নেই সুনির্দিষ্ট লেইন। ফলে বেপরোয়া গতির মোটর সাইকেলসহ যে কোনো যানবাহনের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, গেল অক্টোবর মাসে সারাদেশে ৫৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫৭৯ জন। এর মধ্যে শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাতেই মারা গেছেন ২২১ জন। শতকরা হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৩৭ দশমিক ৫২ ভাগই মারা গেছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত চালক ও আরোহীদের অর্ধেকের বয়সই (৫১.৪২%) ১৪ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। কিশোরুযুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনার কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পড়ছে এবং অন্যদেরও বিপদে ফেলছে বলে পর্যবেক্ষণ দিচ্ছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন কিছু সুপারিশ জানিয়েছে। সংগঠনটি বলছে, দক্ষ চালক তৈরি উদ্যোগ বৃদ্ধি, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ‘র সক্ষমতা বৃদ্ধি, যানবাহন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও পথচারীদের মধ্যে ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কের স্বল্প গতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে সেগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা তৈরি, সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ, গণপরিবহনের চাঁদাবাজি বন্ধ, রেল ও নৌপথ সংস্কার এবং সমপ্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো, টেকসই গণপরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং সড়ক পরিবহন আইন–২০১৮ বাস্তবায়ন করতে পারলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।
তবে ট্রাক–সহ পণ্যবাহী যানবাহন ও মোটরসাইকেলের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কেননা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যান্য যানবাহনকে আক্রান্ত করছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আমাদেরকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মোটরসাইকেলে চলাচল নিরুৎসাহিত করা জরুরি।