১ মে – আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস। বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বের শ্রমিকরা প্রতিবছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস তথা মে দিবস পালন করেন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আট ঘন্টা কর্মদিবসের দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস রূপান্তরিত হয় ১৮৯০ সালের আন্তর্জাতিক মে দিবসে। ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে প্রতিবছর শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি, সৌভাতৃত্ব ও সংগ্রামের দিন বলে ঘোষিত হল। প্যারিস সম্মেলনের ঘোষণার পর থেকেই মে দিবস পালিত হয়। মে দিবস হল দুনিয়ার মেহনতী মানুষের সংকল্প গ্রহণের দিন। এই সংকল্প হল সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শ্রেণি বৈষ্যমের বিলোপ সাধন। পুঁজিবাদী দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দৃঢ় অঙ্গীকার। মে দিবস শ্রমিক শ্রেণির চিন্তা চেতনায় এনেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের উৎসবের দিন, জাগরণের গান, সংগ্রামে ঐক্য ও গভীর প্রেরণা, মে দিবস শোষণ মুক্তির অঙ্গীকার। মে দিবস শ্রমিক সংহতি দিবস। মে দিবস কাজের সময় নির্ধারণ ও মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন, ন্যায্যতার দাবী। লেনিন মে দিবসকে ব্যবহার করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণির বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বলিষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। তারই সার্থক পরিণতি ১৯১৭ সালের নভেম্বর বিপ্লবে। মে দিবস দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চক্রান্তের তীব্র প্রতিবাদ, দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির এক হওয়ার, জেগে উঠার ও সংগঠিত হওয়ার উজ্জীবনী মন্ত্র।
বাংলাদেশেও দিবসটি যথা গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। সরকার, সরকারি দল, বিরোধী দল সমূহ, শ্রমিক সংগঠন সমূহ, বিশেষ করে বামপন্থী সংগঠন সমূহ, সিভিল সোসাইটি, উন্নয়ন সংগঠন সমূহ, বর্তমান প্রজন্মের উদ্যোক্তা, মালিক, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, ছাত্র যুবা তথা নারী পুরুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, কর্মী বান্ধব শ্রম ও কর্ম পরিবেশ গড়ায় উদ্বুদ্ধকরণ তথা শ্রম অধিকার বিষয়ে সংগঠিত করার লক্ষ্যেই দিবসটি পালিত হয়।
মে দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য “শ্রমিক মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি”
অতিমারী কোভিড–১৯ এর প্রভাব এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মাঝেই এবারের মে দিবস। পুরো বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও জীবন জীবিকা শ্লথ এবং শ্রমজীবী মানুষ অধিকতর বিপর্যস্ত। চীন, ভারত, ফিলিপাইন কিংবা ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা মজুরী কম পায়, চা শ্রমিকদের এখনো আন্দোলন করতে হয়। পরিবহন সেক্টরসহ অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে কর্মরত শ্রমজীবীদের নেই নিয়োগপত্র, নেই ন্যায্য পাওনা ও সুযোগ সুবিধাদি যদিও সিংহভাগ শ্রমজীবী এসব সেক্টরে কাজ করে। বিবিএসের সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায় বৈষম্য বেড়েছে,দারিদ্য কমেছে।
মহান জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ থেকে উন্নয়নশীল বাংলাদেশ – কৃষক, শ্রমিক, সব শ্রেণি পেশার মানুষ ছাত্র যুবা তথা নারী পুরুষের সম্মিলিত অর্জন। বৈষম্যহীন, অসমতা, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বিজ্ঞান মনস্ক, সুখী সাম্যের বাংলাদেশ গড়াই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাস্তবতা হলো আমরা এখনো শ্রমবান্ধব কর্ম পরিবেশ পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত করতে পারিনি। বৈষম্য নারী কর্মী পুরুষ কর্মীতে, নারী শ্রমিক–পুরুষ শ্রমিকে মজুরী, সুযোগ–সুবিধা ও মর্যাদার ক্ষেত্রেও। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ ৩৬ শতাংশ তা আরো বেগবান হওয়া জরুরী।
সাম্প্রতিক গবেষণা ও প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে জানা যায় কর্মস্থলে, শিক্ষাঙ্গানে, গণপরিবহণে ও জন সমাগমে (Public Place) নারী যৌন নির্যাতন ও হেনেস্তার শিকার হয়, মজুরী, সুযোগ–সুবিধা ও মর্যাদার ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হয়। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অঙ্গীকারই হচ্ছে লিঙ্গ সমতা, সর্বোপরি অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন– কাউকে পেছনে রেখে নয়। দেশের সংবিধান ও সবার সমান সুযোগ ও হিস্যার কথাই বলে।
জনশুমারী ও গৃহগণণা ২০২২’র সমন্বয়কৃত গণাণয় জানা যায় দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। তন্মধ্যে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (১৫–৫৯ বছর) ৬২ শতাংশ যা ১ কোটি ৫০ লাখ। ২৮ শতাংশ তরুণ এদের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৮ লাখ (বিবিএস)। কিন্তু ইউএনএফপিএ’র ‘বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২৩’ এ বলা হয় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩০ লাখ (প্রথম আলো, ২০এপ্রিল ২০২৩)।
জাতীয় যুবনীতি ২০১৭ অনুযায়ী ১৮–৩৫ বছর বয়সীরা যুবা অবশ্য জাতিসংঘের বর্ণনায় ১৫–২৪ বছর বয়সীরা যুবা। বিবিএস’র সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায় দেশে ২৯ বছরের কমবয়সী জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৫৬.৭৭ শতাংশ। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে প্রায় ৯ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার বয়স ২৯বছরের কম। Demographic Dividend জনমিতিক সুফল, অর্থনীতিবিদদের ভাষায় Window of Opportunity ২০৩২/৩৩ সাল পর্যন্ত। সাম্প্রতিক তথ্যে জানা যায় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কর্ম কোন কিছুতেই নেই ২৯.৮০ শতাংশ যুব যাদেরকে NEET বলা হয়। আবার যুবদের মধ্যে মাদকাসক্তের হার উদ্বেগজনক। বাংলাদেশে সব মিলে শ্রমজীবী মানুষ ৬ কোটির বেশি, কর্ম প্রার্থী মানুষের সংখ্যা কমবেশী ৫ কোটি। বেকার ও ছদ্মবেশী বেকারের সংখ্যাও উল্লেখ করার মতো।
শ্রম সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালা:
সংবিধানের ১৮,২৮,৩৮ ও ৪০ অনুচ্ছেদের আলোকে এবং আইএলও কনভেনশন অনুসরণে শ্রমনীতি ও শ্রমিক কল্যাণে বহুমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়নে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ।
জাতীয় শ্রমনীতি ২০১২ তে নারী শ্রমিকের জন্য সমমজুরি ও সমঅধিকারের উপর গুরুতা্বরোপসহ নারী শ্রমিকদের জন্য সকল ধরণের মজুরি বৈষম্য নিরসনের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮), তবে শ্রম আদালত বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সুনজর দেওয়া জরুরী।
বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন শীর্ষক প্রকল্প চলমান। উল্লেখ্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ৩৮টি এবং তা দন্ডণীয় অপরাধ।
শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) এর ধারা ২৩৪ এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে।
গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতমালা–২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। তা আইনে পরিণত করা সময়ের দাবী।
জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রার ১৭টির মধ্যে: ১.দারিদ্র নির্মূল ২. ক্ষুধা মুক্তি ৩. সুস্বাস্থ্য ৪.মানসম্পন্ন শিক্ষা ৫. লিঙ্গ সমতা ৬. বিশুদ্ধ পানি ও পয়োঃ নিষ্কাশন ৭.সাশ্রয়ী ও নবায়নযোগ্য জ্বালানী ৮. উপযুক্ত কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৯. শিল্প উদ্ভাবন ও অবকাঠামো ১০.বৈষম্য হ্রাস ১১.টেকসই শহর ও জনগণ ১৩. জলবায়ু বিয়ষক পদক্ষেপ ১৬. ন্যায় বিচার– এ লক্ষ্যে গুলো পূরণে জোর দেয়া জরুরী শ্রমিক শ্রেণি তথা শোষণ, বঞ্চনা অসমতা ও বৈষম্যের শিকার মানুষগুলোকে রক্ষার জন্য।
মানুষ বাড়ছে শুধু বাংলাদেশে নয় বৈশ্বিকভাবেও। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের বরাতে জানা যায় ২০২৩ এর মাঝামাঝিতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৮০৪ কোটি ৫০ লাখে দাড়াঁতে পারে। আর বিশ্বের জনবহুল দেশ চীনকে পেছনে ফেলে ভারতের জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ৮৬ লাখেরও বেশি হবে পক্ষান্তরে একই সময় চীনের জনসংখ্যা হবে ১৪২ কোটি ৫৭ লাখ (এএফপি, দিল্লী / প্রথম আলো, ২০ এপ্রিল ২০২৩)।
জরুরী করণীয় হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে মাথায় রেখে পাঠক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন আনা – একাডেমিয়ার সাথে এন্টারপ্রাইজের নিবিড় সংযোগ ঘটাতে হবে উন্নত দেশগুলোর মতো। দক্ষ জনশক্তি গড়ার লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষার চেয়ে Technical Education and Vocational Training (TEVT), IT এবং নানা ভাষা শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। আইএলও’র তথ্য অনুযায়ী এশীয়–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিক্ষিত বেকারত্বের হারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। কর্মমুখী শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় স্নাতকদের ৪৭ শতাংশ বেকার, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষিতদের মধ্যে ২৯.৮ শতাংশ বেকার আর তারও নিচের স্তরে ১৩.৪ শতাংশ বেকার।
মার্কস বলেছেন সমাজ সমূহের ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণি দ্বন্দ্বের, শ্রেণি সংগ্রামের। দার্শনিকরা শুধু সমাজের ব্যাখ্যাই করেছেন অথচ মূল বিষয়টা হচ্ছে পরিবর্তন আনা। বুর্জোয়া রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অর্থনীতিবিদদের উদ্ভাবিত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ধারণা ইত্যাকার কর্মসূচির মাধ্যমে–ঝালাই জোড়াতালি দিয়ে সমাজ কিংবা শ্রমিক শ্রেণি দিনাতিপাত করছে বটে কিন্তু মে দিবসের মূল যে অঙ্গীকার সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শোষণ বঞ্চনা ও বৈষম্য মুক্ত সমাজ গড়া তা আজতক অধরাই রয়ে গেল। মে দিবস অমর হোক।
লেখক : সমাজবিজ্ঞানী ও সিনেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান ঘাসফুল।