সুখের সীমা নেই নোরার। বিদ্বান, বুদ্ধিমান, উচ্চপদে কর্মরত, দায়িত্ববান ও প্রেমময় স্বামী, আট বছরের সংসারে তিন তিনটি দেবশিশু। সামাজিক মর্যাদা, আরাম আয়েশের কমতি নেই কোথাও। ঠিক যেন আমাদের শাবানা অভিনীত চলচ্চিত্র ‘আমার এ ঘর যেন স্বর্গ’, ‘কিংবা আমার ঘর আমার বেহেশত’। তবে ঠিক উচ্চবিত্ত বলা চলে না নোরাদের। তাই বাজারের সেরা পোশাক কিংবা সবচেয়ে দামী খেলনাটা কিনতে পারে না ছেলেমেয়ের জন্য। তা নিয়েও আর ভাবনা নেই। আসছে মাসে পদন্নোতি হবে নোরার স্বামীর, সেই সুবাদে বাড়বে বেতনও। এবার আরও হাতখুলে খরচ করতে পারবে নোরা। স্বামীটি যদিও তার অপচয় করাকে ঠিক পছন্দ করেন না, তবে নোরার আনন্দে খুব একটা বাধ সাধেন না। নোরা প্রাণভরে স্বামী সন্তানের জন্য, তার সুখের সংসারের জন্য এটাওটা কেনাকাটা করে। আর নতুন বছরে কী কী করবে তার পরিকল্পনা করে। তবে নিজের জন্য সে তেমন কিছু কেনে না। স্বামীর বরাদ্দ টাকা থেকে তুলে রাখে স্বামীর অগোচরে। টানাটানির সংসারে যেমন হয়। কিন্তু ব্যস্ত স্বামীর তা আর খুঁটিয়ে দেখা হয় না। নোরার ছেলেমানুষী তাকে আরও বেশী মুগ্ধ করে। স্বামীর চোখে নোরা কখনও কাঠবিড়ালী, কখনও ছোট্টপাখি, কখনওবা গানের পাখি আবার কখনও নাচের পুতুল। হাসি আনন্দ খুনসুটিতে দিন চলে যায়। বড়দিনের ঠিক আগে আগে উন্মোচিত হয় রহস্য। না নোরার স্বামীর কাছে নয়, দর্শক কিংবা পাঠকের কাছে। কে এই নোরা?
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস হাউজ’ নাটকের মূল চরিত্রের নাম নোরা। স্বামী সন্তান সংসার-অন্ত প্রাণ এই নারী ভালবাসার জন্য জীবন দিতে তৈরি। সে বিশ্বাস করে তার সন্তানদের বাবা মানুষটিও তাই। তাইতো মানুষটার ওপর তার চিরন্তন নির্ভরতা। তার ইচ্ছেই নোরার ইচ্ছে। তার মনের মতো হবার জন্য, তার মনের মতো করে সংসারটাকে সাজাবার জন্য খেটে মরে নোরা। নিজের ইচ্ছের কথা ভেবে দেখার সময় হয় না, ইচ্ছেও হয় না। বড়দিনের আগে কী এমন হয়, যা অস্থির করে তোলে নোরাকে? নোরার স্বামীর দপ্তর হতে সদ্য কর্মচ্যুত লোকটির কথা শুনে ঘাবড়ে যায় কেন নোরা? আর লোকটিইবা এমন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে কেন? কী অপরাধ করেছিল নোরা? এই লোকের কাছে কীসের দায় তার? কেনইবা সব লুকোতে চায় সে স্বামীর কাছ থেকে? লোকটির দাবি নোরা প্রতারণা করেছে। সত্যিই কী তাই?
বেশ ক’বছর আগের কথা। নোরার স্বামী গুরুতর অসুস্থ, ডাক্তার হাওয়া বদলের পরামর্শ দেন। কিন্তু তখনও এতটা বিত্তশালী ওরা ছিল না যাতে হাওয়া বদলের খরচ অনায়াসে বহন করতে পারে। নোরা হার মানতে রাজি নয়। নিজের বাবার নামে এক ধনবান ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ধার করে, কারণ উনিশ শতকের শেষার্ধে নরওয়ে দেশে কোন মেয়ের পক্ষে টাকা ধার করার বিধান ছিল না। বাবার নামে টাকা ধার করায় তেমন সমস্যা নোরার হয়নি, অন্তত পাওনাদার মানুষটা কপর্দকশূন্য না হয়ে পড়া পর্যন্ত। নোরার স্বামী জানতেন নোরার বাবাই এই টাকা দিয়েছেন। এরই মধ্যে নোরার বাবা চোখ বুজলেও স্বামীর চিকিৎসায় কোন কার্পণ্য নোরা করেনি। দক্ষিণে হাওয়া বদল শেষে যথাসময়ে স্বামীকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরে আসে। প্রতিশ্রুতিমতো কিস্তিতে টাকা শোধ করতে থাকে সে ধীরে-ধীরে গোপনে, সংসারের টাকা বাঁচিয়ে। এতক্ষণে বোঝা গেল অবস্থাপন্ন পরিবারের গৃহিণী হয়েও কেন নোরা মূল্যহ্রাসের দোকান থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য বড়দিনের উপহার কেনে, বিশেষ করে নিজের জন্য কিছু কেনে না বললেই চলে।
স্বামীর কৈশোরের সহপাঠী, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সদ্য চাকরিচ্যুত লোকটিই নোরার পাওনাদার, যে নিজের জীবনের পরাজয়ের মুখে শোধ নিতে মরিয়া। নোরাকে ভয় দেখায়। কারণ বাবার নামে ধার করা টাকার রশিদে বাবার স্বাক্ষর জাল করেছিল নোরা। বাবার মৃত্যু, স্বামী মৃত্যুশয্যায়- বিচলিত নোরার আগপাশ ভাবার মতো মনের অবস্থা ছিল না। বাবার স্বাক্ষরের পাশে তারিখ আর বাবার মৃত্যুর তারিখ মিলিয়ে গোঁজামিলটা আবিষ্কার করে ফেলে পাওনাদার। নোরাকে জব্দ করার জন্য বিশেষত তার স্বামীর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার আর হয়না। নোরা তার কাছে সময় চায়, মিনতি করে তাকে গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু তার পিঠ ঠেকে আছে দেয়ালে; সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে মরার অবস্থা।
অতঃপর নোরাদের বাড়ির চিঠির বাক্সে স্বামীর নামে চলে আসে সেই চিঠি। আফসোস। এই বাক্স খোলার চাবি কেবল একজনেরই আছে। আট বছরের সংসারে চিঠির বাক্স খোলার অধিকারটুকুও নোরার নেই, এই প্রথম অসহায়বোধ করে নোরা। তার সাহায্যে এগিয়ে আসে বাল্যবন্ধু ক্রিস্টিন। পাওনাদার মানুষটির সঙ্গে তার পূর্বপরিচয় ছিল। কেবল পরিচয় নয়, ঘর বাঁধার কথা ছিল তাঁদের। জীবনের জটিল ঘূর্ণিপাকে পড়ে তা আর হয়ে ওঠেনি। ক্রিস্টিনের অনুরোধে, নতুন করে জীবন গড়ে নেয়ার আশ্বাসে ভরসা করে নোরার ওপর থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় পাওনাদার। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। কপট ছলনায় স্বামীকে ভুলিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হয় না। নোরার স্বামীর হস্তগত হয় অভিযোগপত্রটি। রাগে অপমানে অগ্নিশর্মা হয়ে নোরাকে ধিক্কার দেন তিনি। তার মৃত পিতাকেও ছেড়ে কথা বলেন না। ভালোবাসার ছোট্ট পাখিটিকে অপমানে অপমানে জর্জরিত করেন তিনি। নোরার মতো অর্বাচীন নারীর সংস্পর্শে থেকে তার সন্তানদের অকল্যাণ হবে, এই আশংকার কথাও বলে ফেলে অকপটে।
বাকরুদ্ধ নোরা এই মানুষটিকে চেনেনা। তার এতদিনের ভালবাসার ঘর, সুখের স্বর্গ, স্বপ্নসৌধ ভেঙে যায় ঝুরঝুর করে। এ-ঘর আর তার নয়- নোরা মনস্থির করে ফেলে। এমন সময় চিঠির বাক্সে নতুন চিঠিটি আসে নোরার নামে; পাওনাদারের অভিযোগ প্রত্যাহারের চিঠি। তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার নিয়ে নিজেই সে-চিঠি খুলে পড়তে শুরু নোরার স্বামী। মুহূর্তেই মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। আর ভাবনা নেই। সব জ্বালা মুছে যায় তার চোখমুখ হতে। সমাজে মানহানির ভয় নেই আর। তীব্র আবেগে নোরাকে আলিঙ্গন করতে ছুটে যায় সে। কিন্তু নোরা যে আর তার সেই ছোট্ট পাখিটি নেই, এই প্রথম নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে, তা তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেন না। নোরার ভাবলেশহীন নির্লিপ্ততায় অবাক হন তিনি। কিন্তু একটিবারের জন্যও নিজের উদ্ধত আচরণের জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননা। নোরা যে তাঁর জীবন বাঁচাতেই এতকিছু করেছে সেকথা তাঁর মনের কোণে উঁকি দেয়না। উপরন্তু, ধিক্কার অপমানে কোণঠাসা হয়ে পড়া নোরাকে ‘ক্ষমা করে দিয়েছেন’ বলে মহানুভবতার পরিচয় দেন তিনি! ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ছাড়ার জন্য তৈরি হয় নোরা।
নোরার স্বামী টোরভাল্ট হেলমার নোরাকে এত রাতে বাইরে যাবার পোশাকে দেখে অবাক হন। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাকে মুছে ফেলার কথা বলেন। এই ‘কিছুক্ষণ’ সময়ে নোরার যে পুনর্জন্ম হয়েছে সেকথা বোঝার মতো মানবিক শক্তি নেই শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী জনাব হেলমারের। কারণ একজন পুরুষের কাছে সম্মানের চেয়ে বড় কিছু নেই। “কোন পুরুষই নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ করেনা, ভালোবাসার মানুষের জন্যও না”। হাজার হাজার মেয়ে কিন্তু তা করেছে এবং করছে- নোরার সহজ স্বগতোক্তি। এতগুলো বছরে তাঁদের দু’জনের মাঝে কোন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে কিনা মনে করতে পারে না নোরা। কেবলই খুনসুটি, হাসি আনন্দ। নোরা দিনরাত কেবল টোরভাল্টের আনন্দ, টোরভাল্টের খুশি, টোরভাল্টের ভাল লাগা মন্দ লাগা নিয়েই ভেবে মরেছে। নিজের পছন্দ কী, অপছন্দই বা কী জানা হয়নি তার এতকাল। বাবার ঘরে ছিল বাবার প্রিয় পুতুল, স্বামীর ঘরে এসে স্বামীর। আর নয় পুতুলের জীবন। টোরভাল্ট নোরাকে সন্তানদের দোহাই দেয়, ধর্মের দোহাই দেয়। নোরা নির্বিকার, অটল অনড়; আত্মপ্রত্যয়ে দীপ্ত এক পরিপূর্ণ ব্যক্তিসত্তা। রাত পোহাবার অপেক্ষায় থাকে না। অচেনা মানুষের সাথে ঘর ছাড়ে রাতের অন্ধকারে।
ইবসেনের ‘এ ডলস হাউজ’ কে ‘নোরা’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন আমাদের একজন খ্যাতিমান নাট্যশিল্পী, প্রিয় অভিনেতা খায়রুল আলম সবুজ। অনুবাদকের মুখবন্ধ থেকে জানা যায় ‘এ ডলস হাউজ’ এর প্রথম মঞ্চায়ন হয় জার্মানিতে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে। মাত্র এক দশক আগে জার্মান জাতীয়তাবাদ ও অটোভন বিসমার্কের ‘রক্ত ও লৌহ’ নীতির বদৌলতে পুরো জার্মান ভূখণ্ড নিয়ে জার্মান জাতিগোষ্ঠী একত্রিত হয়েছিল। পরিবর্তনের হাওয়া ইউরোপজুড়ে। ইতোমধ্যে জ্ঞানদীপ্তি, শিল্পায়ন, নগর সভ্যতা এমনকি সমাজতন্ত্রের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে গেছে ইউরোপবাসীর। কার্ল মার্ক্সের ‘ডাস ক্যাপিটাল’ রচিত হয়েছে আগেই। মার্ক্স-এঙ্গেলসের ‘দ্যা কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো’ ঝড় তুলতে শুরু করেছে পশ্চিমা দুনিয়ায়। এমনই উদার (!) পরিবেশে সমাজের চাপে ‘এ ডলস হাউজ’ এর প্রথম মঞ্চায়নে স্বয়ং নাট্যকারকেই পাল্টে দিতে হয়েছিল শেষ দৃশ্য। সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে নিজের সংকল্প থেকে সরে আসে নোরা, এবং ঠিক রূপকথার মতোই ‘অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’। এই অবশ্য শেষ। নোরাকে আর জোর করে পুতুল বানিয়ে হেলমারদের ঘরে বেঁধে রাখা যায়নি। ‘ইবসেনের গল্পের মেয়েরা এরপর থেকে নোরার মতো আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে স্বামী সন্তানসহ জীবন যাপন করতে শুরু করে’ উনিশ শতক শেষ হবার আগ থেকেই, যা নিঃসন্দেহে নতুন বার্তা দিয়েছিল সমাজকে।
তবে একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের সমাজে আজও দেখা পাওয়া যায় নোরাদের, শেষ দৃশ্যের সেই আত্মপ্রত্যয়ী নোরা নয়, বরং পুতুল নোরার। আবার ভিন্ন ছবিও দেখা যায়। তাহলে ইবসেনের ‘নোরা’ আমাদের কি শেখাল? ঘর ভেঙে নিজের জয়? তা কিন্তু নয়। নারীর ছোঁয়া ও মমতা ছাড়া কোন সংসারই সুন্দর হয় না- তা যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি- কিছুতেই নিজেকে ছোট করা নয়, আত্মাকে কষ্ট দেওয়া নয় এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে অতিনাটকীয় কায়দায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করে অন্যদের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেওয়াও নয়। ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধ ছাড়া নারী কেবলই কারও না কারও মানসী, মানুষ নয়। পিতা কিংবা পতির বিত্তবৈভব নয়, সুশিক্ষা ও আত্মনির্ভরশীলতাই একজন নারীর অবলম্বন ও রক্ষাকবচ।