অকালপ্রয়াত কবি শওকত হাফিজ খান রুশ্নির উচ্চারণ ‘সমস্ত সাহসকে একত্র করে বলছি।’ তেমনই ডা. শাহাদাত হোসেন সাহসিকতার সাথে বলেছেন, তার নিয়োগের পরপর চন্দনাইশ মিডিয়া ক্লাবের রিসিপশনে বলেছেন, “আমি সিটি গভর্নমেন্ট চাই।” তাঁর পূর্বসূরিদের করুণ পরিণতি জেনেও তিনি ঢাকাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, উপদেষ্টা আমার ফাইল বাসায় নিয়ে যায়। তাঁর সকল বক্তৃতা শুরু হয় ৫২’র ভাষা আন্দোলন দিয়ে। একাত্তরের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ।’ সকল বৈষম্যের অবসানের কথা তিনি বলেন। গত বর্ষা মৌসুমের প্রাক্কালে বাংলাদেশ জনসংযোগ সমিতি চট্টগ্রামের রাউন্ড টেবিলে বলেছেন, ‘চেয়েছি ৮০০ টাকা, পেয়েছি ৫০ কোটি টাকা।’
মূলত সর্বশেষ তথ্য পোর্টের কাছে দাবি ‘৯০ লাখ স্কয়ার ফিটের ৪৭৬ কোটি টাকা, সেখানে অন্তত ২০০ কোটি টাকা দিলে সুবিধা হয়।’ (আজাদী)
সমপ্রতি অনুষ্ঠিত “চট্টগ্রাম কবিতার শহর” শীর্ষক তারুণ্যের উচ্ছ্বাস এর এক বর্ণিল উৎসবে তিনি বলেছেন, “চট্টগ্রাম সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূতিকাগার।”
মহাকালের পদযাত্রায় একবছর সময় অত্যন্ত নগণ্য (কালান্তর, রবীন্দ্রনাথ)। কিন্তু মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন প্রোভেন অ্যান্ড ট্রেস্টেড লিডার, জনগণমননন্দিত অধিনায়ক একজন সাহসী কার্যক্রম গণ্য করতে হবে। বিশেষ করে, দৈনিক আজাদীর মোরশেদ তালুকদার, রাজস্ব আদায়ে সিরিজ প্রতিবেদন করছিলেন তখনই মেয়র তার দ্রুত অ্যাকশনে যান, তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই হোল্ডিং ট্যাক্স জালিয়াতির মাধ্যমে দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৪০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা উন্মোচিত হয়। মেয়র কালবিলম্ব না করে জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজস্ব বিভাগের দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন এবং তিনজন হিসাব সহকারীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে অন্য বিভাগে সংযুক্ত করেন। দৈনিক আজাদীতে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘আসলে এখানে দীর্ঘদিনের একটা জঞ্জাল আছে, যার কারণে আমি যে মেধা নিয়ে কাজ করছি বা যে স্পীডে চলছি, সেভাবে তারা চলতে পারছে না।’
সাংগঠনিক দক্ষতা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নাগরিক সম্পৃক্ততাসহ (সিটি গভর্ন্যান্স) ১৫ ক্যাটাগরিতে ১২টি সিটি কর্পোরেশন (চসিক) প্রথম সবার গৌরব অর্জন করেছে এ সময়কালে। কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে তিনি ৪১টি ওয়ার্ডকে ৬টি জোনাল ভাগে ভাগ করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে যাচ্ছেন। গ্রিন সিটির লক্ষ্যে ১০ লক্ষ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা রোপণ করেছেন, সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ৩টি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিগ্রহণ করেছেন। এনজিও মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি ইউএনডিপি, ইউনিসেফ এর সহায়তায় প্লাস্টিক সংগ্রহ প্রসেসিং, সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যুবক ও তরুণদের শারীরিক ফিটনেসের জন্য ৪১টি ওয়ার্ডে ৪১টি খেলার মাঠ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি শিশুদের ভালোবাসেন। হালিশহর শিশুপার্কের প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। আজাদীতে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “আগ্রাবাদ শিশুপার্ক বিপ্লব উদ্যানের কাজ চলছে।”
“বর্জ্যই সম্পদ” এই স্লোগানে তিনি ১৫ই অক্টোবর বর্জ্য থেকে জ্বালানি উৎপাদন হালিশহর আনন্দবাজারে ল্যান্ডফিল্ড প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন এবং পলিথিন বিরোধী আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
১৬২ বছরের প্রাচীন এই সেবা সংস্থা ড. ইউসুফ ইকবাল দীপুর ভাষায় শিক্ষা, সেবা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের একটি আইকনিক সেবাখাত। ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান নূর আহমদ এমএ বিএল (১৮৯০–১৯৬৪) এ শিক্ষাখাতের সূত্রপাত করেন।
মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন স্কুল শিক্ষার্থীর জন্য স্কুল কমিটি গঠন এবং স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ, স্কুল হেলথ স্কিম চালু, বাচ্চাদের হেলথ চেকআপ। কেবল একজন চিকিৎসক মেয়রের পক্ষেই এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব। লক্ষ্য করা যায়, নগরীর বিভিন্ন আইল্যান্ডে শোভা পাচ্ছে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সচেতনতার জন্য খুব চমৎকার প্রদর্শনী, ২০২৫ এ এই প্রথম বারের মতো ৮ লাখ ২৯ হাজার শিশুকে টাইফয়েড টিকা প্রদান করা হয়। আমরা আরও লক্ষ্য করি, এসব চসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন ছাত্রী সমপ্রতি “নতুন কুঁড়ি” তে সমগ্র দেশে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।
মাননীয় মেয়রের একবছর পূর্তি শুভ লগ্নে আরেকটি সুসংবাদ হচ্ছে, চসিক শিক্ষাসেবার শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে। অথচ চসিকের এ শতবর্ষী আইকনিক ও বিস্তৃত শিক্ষাসেবার খাতটি দৃষ্টীয় স্বীকৃতির অগোচরে থেকে গেল। স্বীকৃতির জন্য যথাযথ ভূমিকা প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে। শিক্ষাখাতে শতাব্দীর এ অনন্য অবদানের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রামের জনগণ আরেকবার প্রবলভাবে গর্বিত হতে পারবে। আমরা আশা করছি, মেয়র আগামী সুবিধাজনক সময়ে চসিক শিক্ষাসেবার শতবর্ষী শীর্ষক একটি গ্লোরিয়াস ও প্রেস্টিজিয়াস প্রোগ্রাম পরিকল্পনা করতে পারেন। যাতে করে সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মেয়রের এ অবদানকে স্বীকৃতি দিতে পারে।
থিয়েটার ইন্সটিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) নিয়মিত নিরীক্ষামূলক নাটক ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ইতোমধ্যে মেয়র এটাকে “ইনডিভিজুয়াল ইনস্টিটিউট” হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলেছেন। সে সাথে আয়বর্ধক ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার কথা বলেছেন, সবুজায়নের কথা বলেছেন, শিশু ও শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা মেয়র ঘোষণা করেছেন, টিআইসি–এর পূর্বদিকে একটি স্থায়ী মুক্তমঞ্চ করার পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলেছেন। প্রবন্ধকারকে পরিচালক হিসেবে অ্যাসাইনড করার পর শর্ট, মিড এবং লং–টার্ম একটা কনসেপ্ট পেপার মেয়র বরাবর পেশ করা হয়েছে। মূলত থিয়েটার ইন্সটিটিউট, শহিদ মিনার, গণগ্রন্থাগার ও মুসলিম হল, নজরুল স্কোয়ার (ডিসি হিল) কে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটি কালচারাল হাব করার প্রকল্প পেশ করেন। আমরা আশা করি, মাননীয় মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে আগামীতে চট্টগ্রাম নিখিল সংস্কৃতির লালনসহ চসিক পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের সংস্কৃতিমনা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের, সাংস্কৃতিক বিভাগও থিয়েটার ইন্সটিটিউট নিয়ে একটি ইন্টিগ্রেটেড কালচারাল প্রকল্প বিবেচনায় রাখতে পারেন।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক রাজধানীর মেয়র তিনি। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের টেরিটরিও বৃদ্ধি পেয়েছে। চট্টগ্রাম শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও সমৃদ্ধ। চট্টগ্রাম হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যের ভরকেন্দ্র। ৩ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রবেশমুখ আসছে চীনের রিলোকেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, কোরিয়ান বিনিয়োগ। এ প্রেক্ষাপটে ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলবার জন্য যাবতীয় অবকাঠামো, মনোরেল স্থাপনের পরিকল্পনাসহ গ্রহণ করতে হবে। চট্টগ্রামে প্রায় বাণিজ্য বিনিয়োগের জন্য কূটনৈতিকগণ মেয়রের সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি সেখানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কনট্রিবিউট করতে পারেন। স্থানীয় এক দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বাঁচলে বাঁচবে বাংলাদেশ।’
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের লালদিঘির পাড়ে একটি কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি রয়েছে, যা ১৯০৪ সালে কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা হয়। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রেফারেন্স লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিত, যেখানে অনেক পিএইচডি গবেষক ও পাঠক সমবেত হন। তবে রেফারেন্স লাইব্রেরি হিসেবে এর কার্যকারিতা বজায় রাখতে এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে আধুনিক গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন অপরিহার্য। প্রথম বর্ষে সিরেমোনিয়াম প্রোগ্রাম হচ্ছে। সচিব আশরাফুল আমিন ও পিআর এন্ড প্রোটোকল অফিসার আজিজ আহমেদের সম্পাদনায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে।
সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন পথ চলার সময় যেখানেই বর্জ্য বা যানজট লক্ষ্য করেন, অবিলম্বে নিজে নেমে গিয়ে তা সমাধানের উদ্যোগ নেন। এছাড়া অবৈধ হকারদের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা থেকেও তিনি মুহূর্তেই ব্যবস্থা নেন। এভাবেই তিনি ইতোমধ্যে জনগণের মেয়র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আমরা তাঁর আগামীর সার্বিক সফলতা কামনা করি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার; সাবেক সচিব, চট্টগ্রাম চেম্বার; পরিচালক, টিআইসি।











