মেহেদী এক বাহারী পাতার নাম। যার ইংরেজি নাম HURB, এ পাতার সৌন্দর্য মানব জীবনে তথা মুসলমান নর-নারী একবার হলেও উপভোগ করে থাকেন। মেহেদীর রং কোন প্রকারের তা নিশ্চিত বলা কঠিন, মেহেদীর রং মেহেদীই। মেহেদী গাছ এখন যত্রতত্র দেখা না গেলেও কিছু পরিবারের উঠানে-বাগানে-আঙিনায়-ঘরের ছাদের নির্দিষ্ট টপে নজরে পড়ে। মেহেদী গাছ তেমন বড় আকারের হয় না। মোটামুটি কিছু একটাতে দাঁড়ালেই গাছ থেকে পাতা উঠানো যায়। মেহেদীর ব্যবহার আদি যুগেও ছিল। যেমন আমাদের প্রিয়নবী (স.) এর দাড়ি মোবারকেও মেহেদী ব্যবহার করতেন। কিছু পুরনো লোকে বলেন, মেহেদী যথেষ্ট ঠাণ্ডা প্রকৃতির; এর ব্যবহারে খুশকী দূর হয়; চুলের গোড়ালি শক্ত করে; গৃহ কাজে রমণীদের তাপের কারণে হাতের চামড়ার SENSITIVITYনষ্ট হলে, ইহা সপ্তাহান্তে বা পাক্ষিকে হাতের তালুর মাঝখানে, আঙ্গুলের মাথায় নখ বরাবর ব্যবহার করলে THERMAL BALANCEঅর্জন সম্ভব হয়। এছাড়াও গরম মেজাজের মানুষের মাথায় মেহেদীর প্রলেপ দ্বারা মাথা ঠাণ্ডা করা হতো। বর-কনেকে বিয়ে অনুষ্ঠানের পূর্ব রাতে মেহেদী পরাটা বেশ কাল ধরে সামাজিক প্রথা হিসেবে চিহ্নিত। মেহেদীর রং ছাড়া তেমন কোন বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে তা বলা যাবে না। উপরন্তু বর-কনে বাদেও বরের ছোট ভাই, ভাবী, বোন অনুষ্ঠানে আগত অতিথি ও ছোট শিশুর হাতের তালুতেও এর ব্যবহার দেখা যায়। অপরদিকে কনে ছাড়াও কনের বোন, বান্ধবী এমনকি সমবয়সী কনের খালাদেরও মেহেদী লাগাতে দেখা যায়। সে হিসেবে অধুনা এটা মেহেদী সন্ধ্যা, গায়ে হলুদ, মেহেদী রাত (তেল্লোয়াই) ইত্যাদি নামে পরিচিত। মোট কথা মেহেদী পরার আনন্দটাই আলাদা। স্বাধীনতাউত্তর সময় হতে পাকা গোঁফ, পাকা দাড়ি, পাকা চুল এ মেহেদী দ্বারা রংকরণ খুবই চোখে পড়ে। পাকা চুল, দাড়ি , গোঁফ সাদার চেয়ে মেহেদী লাগানো রংয়ের সৌন্দর্য নজর কাড়ে। সাধারণত মেহেদী পাতার রং বর্ষাকালে পাতলা হয় এবং শীতকালে ঘনীভূত হয়। মেহেদী দেহের সকল স্থানে লাগালেও রং কিন্তু সব জায়গাতে ধরে না, এটাই মেহেদীর আসল বৈশিষ্ট্য। যেমন-রং ধরে শুধু হাতের তালু, নখ, আঙ্গুল, মাথার চলু, দাড়ি , গোঁফেই। কিছু মহিলাকে পায়ের আঙ্গুলে-নখে মেহেদী লাগাতে দেখা যায়, যা মোটেও ঠিক না, কেননা এ দেশের মানুষ মেহেদীকে একটি পবিত্র দ্রব্য মনে করে। মেহেদী ব্যবহার করা মাথার চুলে হালকা তেল ব্যবহারের পর সামান্য রৌদ্রকিরণে চিকচিক করা সোনালি রং এ রূপ নেয়। ‘সোনালি চুল’ নামক একটি শব্দ পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত, বিশেষ করে ইউরোপে স্বর্ণকেশী মহিলার মান অত্যধিক। স্বর্ণকেশে রূপান্তর করতে অনেক প্রকারের কেমিক্যাল ব্যবহার করার পর, শেষতক মেহেদীর রংটিই সোনালি রং এ উজ্জল দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আমাদের দেশে তরুণ বয়সের ছেলে মেয়েদের মাথার চুলের অগ্রভাগে ইলেকট্রিক হিট দিয়ে কেমিক্যাল সমেত সোনালি রং করতে দেখা যায়, যা প্রকৃত মেহেদীর রং কে আজো হার মানাতে পারেনি। বহু বয়স্ক মানুষের মুখ থেকে শোনা: মেহেদী এক সুগন্ধী দ্রব্য যা একদিন ব্যবহারের পর অন্তত সাতদিন খুশবো ছড়াতো। ইদানীংকালে তার ভাটা পড়েছে কারণ পরিবেশ দূষণ, প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতাও এর অন্যতম কারণ। যে হারে মানুষ জন্ম নেয়, সে হারে বৃক্ষরোপনের অভ্যাস আমাদের নেই। তাছাড়া অনেক পশু পাখিও এদেশ থেকে হারিয়ে গেছে। এ বিষয়ে সকল শ্রেণি/পেশার মানুষের সমন্বয়ে সুচিন্তিত পরিবেশ সৃষ্টির যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। মেহেদী শিল্পের যথেষ্ট বিপ্লবও ঘটেছে ইদানীংকালে। বিয়েতে মেহেদী ঘরে ব্যবহার না করে পার্লারে গিয়ে আলপনা সমেত পরা একদিকে মেহেদীর প্রচলন থাকছে ঠিকঠাক অপরদিকে লাভবান হচ্ছে পার্লারের মালিক ও বিউটিশিয়ানগণ।
লেখক: কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক।











