মেরিন ইঞ্জিনিয়ার

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২২ আগস্ট, ২০২২ at ৮:৪৫ পূর্বাহ্ণ

একটা কঠিন কাজ, দুনিয়ায় কেউই পারে না।
জাপানিজকে সেটা বলেন, সে বলবে – কেউই পারেনা? ঠিক আছে আমিই সেটা করে দেখিয়ে দিবো।
আর আরব্যকে বলেন, সে বলবে- ওয়াল্লাহ! কেউই পারে না? তাহলে আমাকে বলতে এসেছো কেন? আমি পারবো ক্যাম্নে?
ধরুন, সেই কঠিন কাজটা দুনিয়াতে মাত্র একজনই পারে।
জাপানীজ: একজন পারে? তাহলে আমাকেও পারতেই হবে। পারবোই।
আরবী: ওয়াল্লাহ। যে পারে, তাকেই দাও না। আমাকে বলছো কেন?
আর, কাজটা যদি দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষই পারে।
জাপানীজ: সব মানুষই পারে আর আমি পারবো না? করেই ছাড়বো।
আরবী: ওয়াল্লাহ! সব্বাইতো পারে। এর জন্যে বেহুদা আমাকে ডিস্টার্ব করো কেন?
আমরা মেরিন ইঞ্জিয়াররাও সেই জাপানীর মতই- আমাদের সব কাজ পারতেই হয়। আমরা সেইভাবেই ট্রেইন্ড।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ার কী কাজ করে? পালতোলা জাহাজের আমলে তো মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বলতে কিছুই ছিলো না। ঊনবিংশ শতাব্দীর দিক থেকে স্টিম-ইঞ্জিন আবিষ্কারের পরে, সেই প্রযুক্তি যখন জাহাজ চালানোর কাজে ব্যবহার করা শুরু হলো, তখন থেকে ধীরে ধীরে এই পেশারও শুরু (১৮২০ সাল)। এরপরে এলো স্টিম-টারবাইন দিয়ে প্রপেলার ঘুরিয়ে জাহাজ চালানো; তারপরে ১৯১০ সালের থেকে শুরু হলো ডিজেল-ইঞ্জিন। এখন পর্যন্ত সেটাই প্রাধান্য বজায় রেখেছে।
বর্তমানের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং একটা বহুমুখী টেকনিক্যাল সাবজেক্ট। প্রধানতঃ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং; কিন্তু সেইসঙ্গে ইলেক্ট্রিক্যাল, ইলেক্ট্রনিক, হাইড্রোলিক, ন্যাভাল-আর্কিটেকচার ইত্যাদি নানান বিষয়ে অবশ্যই জ্ঞান থাকতে হবে। গভীর সমুদ্রে জাহাজের প্রতিটা টেকনিক্যাল প্রবলেমের সমাধানই করতে হয় মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের। অন্যের আশায় বসে থাকলে চলবে না। হ্যাঁ, অনেক কাজই আছে, যেগুলো শুধুমাত্র ড্রাই-ডকে বা বন্দরেই করা সম্ভব; কিন‘ সেগুলো ছাড়া জাহাজের প্রায় সব টেকনিক্যাল কাজই আমরাই করে থাকি। মেরিন-ইঞ্জিনিয়ারিং একদম হাতে-নাতে প্র্যাক্টিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং হ্যান্ড্‌স্‌-অন। চেয়ার-টেবিল-অফিসের কাজ খুবই কম। যদিও আজকাল সব জাহাজেই কম্পিউটার আছে এবং নতুন নতুন রেগুলেশানের জন্য কিছু মেশিনারিজও নতুন।
আমাদের প্রধান কাজ হলো অপারেশান এন্ড মেইন্টেন্যান্স। জাহাজ চালানোর জন্য ডিজেল-চালিত মেইন-ইঞ্জিন আছে, আর সেইসঙ্গে আছে জাহাজের ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার সাপ্লাইয়ের জন্য তিন-চারটা জেনারেটর। সমুদ্রে থাকি বা বন্দরেই থাকি, ইলেক্ট্রিসিটি তো লাগবেই, সেজন্য একটা বা দুইটা জেনারেটর সবসময়ই চলবে। একবার বন্দর ছেড়ে বের হলে, পরের বন্দরে না পৌঁছানো পর্যন্ত, বা নোঙর না করা পর্যন্ত মেইন-ইঞ্জিনও দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা চলতেই থাকবে। চলন্ত অবস্থায় ইঞ্জিনের মেরামত বা মেইন্টেন্যান্স করা সম্ভব না, তাই আমরা সেই কাজগুলোকে বন্দরে বা ড্রাইডকে করি। সমুদ্রে চলন্ত ইঞ্জিন ঠিকমত চলছে কিনা, এবং কখন কোথায় কি তেল-পানি ইত্যাদি লাগবে, সেগুলো দেখ্‌-ভাল করা হয়। আর যে সমস্ত যন্ত্রপাতি চলছে না, সেগুলোর মেইন্টেন্যান্স করা হয়।
মেইন-ইঞ্জিন সমুদ্রে চব্বিশঘন্টাই চলছে, সেটায় কাজ করতে পারছি না ঠিকই, কিন্তু সেটার স্পেয়ার জিনিসগুলোকে রেডি করে রাখা হয়, যাতে পোর্টে গেলেই বদল করে দেওয়া যাবে। জাহাজে অনেক মেশিনারিজেরই ডুপ্লিকেট (বা স্ট্যান্ড-বাই) থাকে। হয়তো আপনার সমুদ্রের পানির জন্যে একটা পাম্প লাগবে; সেখানে দুইটা থাকলে সুবিধা। একটা চলবে, অন্যটার মেইন্টেন্যান্স সেরে নিতে পারবেন। বিদ্যুতের জন্য তিন-চারটা জেনারেটর থাকে। দুইটা হয়তো চলছে, অন্য দুইটার কাজ সেরে ফেলে, এগুলোকে চালিয়ে প্রথমগুলোকে ধরলেন। এভাবেই রুটিন-মেইন্টেন্যান্স চালানো হয়।
এবারে আসি মেশিনারিজ অপারেশানের দিকে। জাহাজের সব মেশিনই আমাদের চালাতে জানতে হয়। ডিজেল-ইঞ্জিন বলেন, পাম্প বলেন, ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটার, এয়ার-কন্ডিশানার,পাওয়ার-জেনারেটর, বয়লার, এয়ার-কপমেপ্রসার, হিট-এক্সচেইঞ্জার সবকিছুই। সমুদ্রের লবণ-পানিকে পরিশোধিত করার জন্য ফ্রেশ-ওয়াটার জেনারেটর। বাথরুমের বর্জ্য-পদার্থ সমুদ্রে ফেলা যাবে না। সেজন্যে রয়েছে স্যুয়েজ-ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। পোর্ট থেকে কেনা জ্বালানি-তেলে অনেক ময়লা থাকে, সেগুলো পরিশোধন করার জন্য পিউরিফায়ার রয়েছে। শুধু ইঞ্জিনরুমের মেশিনারিজ হলেই তো চলবে না, সেই সাথে আছে কার্গো-অপারেশানের অনেক কিছুই-ক্রেইন, উইঞ্চ, তেলের ট্যাঙ্কারে বিশাল বিশাল কার্গো-পাম্প, হ্যাচ খোলার হাইড্রোলিক-মেকানিজম। আমি রেফ্রিজেরেটেড জাহাজে কাজ করেছি, সেখানে প্রতিটা কার্গো-হোল্ড হলো এক-একটা ফ্রিজ বা কোল্ড-স্টোরেজ। সেগুলোকে দেখাশুনা করা। তারপরে রয়েছে কিচেনের জিনিসপত্র।
জাহাজে ইমার্জেন্সির জন্য লাইফ-বোট থাকে, সেগুলোর ইঞ্জিনও সদাপ্রস্তুত রাখতে হয়। কিছুদিন পরপরই চেক করে দেখে নিতে হয়। তা নাহলে, দরকারের সময়ে সেটা না চললে তো জীবন-মরণ সমস্যা। অন্য আরেকটা ইমার্জেন্সি হলো- আগুন। জাহাজে কেউই চাই না ভুল করেও কোথায়ও আগুন লাগুক। চারিদিকে সেন্সর, এলার্ম, ফায়ার-এক্সটিংগুইশার, অটোম্যাটিক স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম সব থাকে। সেগুলোর রেগুলার মেইন্টেন্যান্সও চেক করা। মেইন ফায়ার-পাম্প দুইটা বা আরও বেশী, এবং তার উপরে ইমারজেন্সি ফায়ার-পাম্প থাকে একটা। সব জেনারেটর ফেল করলে, বা ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগলে, জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে, সেটার জন্য ইমার্জেন্সি জেনারেটরও আছে। রেগুলেশান অনুযায়ী, ইমার্জেন্সী ফায়ার-পাম্প আর ইমার্জেন্সি জেনারেটর সবসময়ই ইঞ্জিনরুম থেকে দূরে থাকতে হবে। ইঞ্জিনরুমের আগুন কোনোমতেই নিভানো সম্ভব না হলে, সবদিক বন্ধ করে ফোম দিয়ে ডুবিয়ে আগুন নেভাতে হবে। সেই সিস্টেমও চেক করতে হয়।
মেইন্টেন্যান্স আর অপারেশানের পরে আরেকটা দিক হলো ট্রাবল-শ্যুট বা সমস্যার সমাধান করা। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের এ-ব্যাপারে হাত একদম পাকা। গভীর সমুদ্রে অন্যের ভরসায় না থেকে, কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে, আমরা নিজেরাই সেগুলোকে রিপেয়ার করতে পারি। যেভাবেই হোক আমরা একটা উপায় খুঁজে বের করে রিপেয়ার করতে পারি। সেজন্যই আমরা অনেক ধরনের কাজও জানি-ওয়েল্ডিং, মেশিনিং ইত্যাদি। ঐযে, শুরুর কৌতুকের জাপানীজটার মত।
জাহাজে আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসার ছাড়াও, আমাদের সাহায্য করার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ক্রু থাকে – ফিটার, অয়েলম্যান, গ্রীজার, ইলেক্ট্রিশিয়ান ইত্যাদি। সকলে মিলে, যে যার কাজ ভাগ করে নিয়ে একত্রে আমরা কাজ করে ফেলি।
পুরানো জাহাজগুলোতে কোনো কন্ট্রোল-রুম ছিলো না। ইঞ্জিনরুমের মাঝেই গরমে, বুম-বুম-বুম শব্দের মাঝে আমাদের সব কাজ করে যেতে হতো। ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি যত বাড়তে থাকলো, সেগুলোর জন্য ঠান্ডা এয়ার-কন্ডিশানার দরকার হলো। তাই ’৭০-’৮০-এর দশক থেকে ধীরে ধীরে এয়ার-কন্ডিশান্ড কন্ট্রোলরুম এলো। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যে সেটা একটা আশীর্বাদ।
আগেকার দিনের জাহাজে দিনরাত চব্বিশঘন্টাই ইঞ্জিনরুমে কয়েকজনকে উপস্থিত থাকতে হতো। সমুদ্রে চললে, কমপক্ষে একজন ইঞ্জিনিয়ার আর একজন ক্রু (অয়েলম্যান বা গ্রীজার) – চারঘন্টা ডিউটি ভাগ করা থাকতো। বর্তমানের আধুনিক জাহাজে (UMS- Unattended Machinery Space), ইঞ্জিনিয়াররা সমুদ্রে আটটা-পাঁচটা কাজ করে, রাতের বেলায় এলার্ম দিয়ে চলে আসে। একেকরাতে একেকজনের ডিউটি এবং তার রুমে এলার্ম সেট করা থাকে। এছাড়াও কমন-স্পেসগুলোতেও এলার্ম থাকে- ডাইনিংরুম, গেইম্‌স্রুম। ব্রিজেও এলার্ম থাকে; আর থাকে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের রুমে। কোনো প্রবলেম হলে প্রথমে ডিউটি ইঞ্জিনিয়ারের রুমে, কমন-স্পেসে এবং ব্রিজে এলার্ম বাজবে, সে যাতে যে কোনো জায়গা থেকেই এলার্ম রিসিভ করতে পারে। সে পাঁচমিনিটের মধ্যে এলার্ম না ধরলে, সব ইঞ্জিনিয়ারসহ চিফ-ইঞ্জিনিয়ারের রুমে বাজা শুরু করবে- সব্বাইকে জানিয়ে দিবে। UMS এলার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা জিনিস এক্টিভেট হয়- dead-man alarm, তার নিরাপত্তার জন্য। কারণ UMS জাহাজে এলার্ম বাজলে, শুধুমাত্র ডিউটি ইঞ্জিনিয়ার একা হয়তো ইঞ্জিনরুমে নামবে। সেখানে তার কোনো দুর্ঘটনা হলে, কেউই জানতে পারবে না। সেজন্য, প্রথমতঃ UMS এলার্ম এলে, সে ব্রিজে ডিউটি অফিসারকে জানিয়ে ইঞ্জিনরুমে নামবে। আর বিশ মিনিট পর পর তাকে ম্যানুয়ালি ডেড-ম্যান এলার্ম রিসেট করে জানান দিতে হবে, সে নিরাপদ ও বেঁচে আছে। সেটা না করলে, ব্রিজে এলার্ম বাজবে, এবং ধরে নেওয়া হবে যে তার কোন বিপদ হয়েছে। এভাবেই, একা থাকলেও তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।
শুরু হয় ক্যাডেট ইঞ্জিনিয়ার পদ দিয়ে। এরপরে জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার, ফিফ্‌থ্‌-ফোর্থ-থার্ড-সেকেন্ড ইঞ্জিয়ার। সবচেয়ে উপরে হলো চিফ ইঞ্জিনিয়ার। পদোন্নতির জন্যে সমুদ্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়, আমরা বলি সি-টাইম। তারপরে প্রফেশানাল পরীক্ষা পাশ করতে হয়। কিছুদিন পরপরই বিদ্যা-বুদ্ধি ঝালাই করে সার্টিফিকেট নবায়ন করে নিতে হয়- নতুন নতুন টেকনোলোজি শিখতে হয়। এছাড়াও আমাদের ফায়ার-ফাইটিং ও মেডিক্যাল ট্রেইনিং নিতে হয়। স্পেশাল জাহাজ হলে তার উপরে কোর্স করতে হয়- যেমন তেলের ট্যাঙ্কারের জন্যে বিশেষ কোর্স। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের ইউনিফর্মে কাঁধের এপোলেটে সোনালী দাগ দিয়ে রঙ ট্যাঙ্ক বুঝানো হয়, তার সঙ্গে থাকে বেগুনী রঙ। কেন? কিংবদন্তি অনুযায়ী, টাইটানিক যখন ডুবে যাচ্ছিলো, জাহাজের সব ইঞ্জিনিয়াররা নিজেদের প্রাণের মায়া ত্যাগ করেও গভীর পানির তলায় ইঞ্জিনরুমে ছিলো, পানি পাম্প করে বের করে দিয়ে দিয়ে ডুবে যাওয়াকে বিলম্বিত করার জন্যে- তারা সকলেই মারা গিয়েছিলো, বলে ইংল্যন্ডের রাজা তাদের শ্রদ্ধা জানাতে রয়েল-পার্পল রঙ দিয়েছিলেন এই প্রফেশানকে। অন্যমতে, অনেক বছর আগে থেকেই আর্মি-নেভি-মেরিন সবখানেই ইঞ্জিনিয়াররা নিজেদেরকে অন্য অফিসারদের থেকে পার্থক্য করার জন্যে বেগুনী রঙ ব্যবহার করতো।
একটা কথা বলতে পারি যে, মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আমার ফাউন্ডেশান থাকার কারণে আমি আমার মেরিন-পরবর্তী জীবনে অনেক অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করতে পেরেছি। অ্যামেরিকায় আমি ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নানান ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছি; আমার বহুমুখী মেরিন-ইঞ্জিনিয়ারিং দক্ষতা ভীষণভাবে আমাকে সাহায্য করেছে। কর্মক্ষেত্রে এদেশীয় ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কম্পিটিশানে আমি অনেক এগিয়ে যেতে পেরেছি; কারণ আমি কোনো গন্ডির মধ্যে আটকে থাকি নাই।
refayet@yahoo.com
টলিডো, ওহাইও, ২০২২

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধতুষারধসের মুখোমুখি