বেশ কিছুদিন হলো একটা সিনেমা দেখেছিলাম। সে মুভিটা ভারতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘The Beginning’ (দ্য বিগিনিং)-।
পরিচালক: ইনসিয়া দারিওয়ালা (Insia Dariwala), প্রযোজনা: Equality Now এবং Sahiyo নামের দুটি সংস্থা।
এই ছবিটি নারী খৎনা (Female Genital Mutilation – FGM) প্রথার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। ছবিতে একজন বোহরা মুসলিম (Dawoodi Bohra) মায়ের গল্প দেখানো হয়েছে, যিনি তার মেয়েকে খৎনা করানোর ঐতিহ্য মেনে চলবেন নাকি এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়েন।
চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয়, মেয়েটি তার মায়ের কাছে খৎনা না করানোর জন্য অনুরোধ করে এবং শেষ পর্যন্ত মা এই প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়ান।
ছবির মূল চরিত্র আরওয়া, যিনি নিজে শৈশবে এই খৎনার শিকার হয়েছিলেন। যখন তার নিজের ৭ বছর বয়সী মেয়ে সারার খৎনা করার সময় আসে, তখন আরওয়া মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তার শাশুড়ি এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এই প্রথাকে ধর্মীয় রীতি হিসেবে মানতে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আরওয়া জানেন যে, এই প্রথা তার জীবনে কী গভীর মানসিক আঘাত দিয়েছে।
ছবিটিতে দেখানো হয়, আরওয়ার মেয়ে সারা যখন তাকে এই কাজ না করার জন্য অনুরোধ করে, তখন আরওয়া তার সমস্ত ভয়, মানসিক কষ্ট এবং সামাজিক চাপের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের মেয়ের জন্য এই প্রথা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
‘The Beginning’ ছবিটি নারী খৎনার শিকারদের মানসিক যন্ত্রণার দিকটি তুলে ধরে এবং এর বিরুদ্ধে প্রজন্মগত পরিবর্তন আনার গুরুত্ব তুলে ধরে। এটি এশিয়ার প্রথম কোনো ফিকশন ফিল্ম, যা এই প্রথা নিয়ে তৈরি হয়েছে।
এটি একটি শক্তিশালী বার্তা দেয় যে, এই প্রথা বন্ধ করতে পরিবার এবং সমাজের মধ্যে থেকে পরিবর্তন আনা জরুরি।
মেয়েদের খৎনা মূলত আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে বেশি প্রচলিত। ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই প্রথা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রয়েছে নিম্নলিখিত দেশগুলোতে:
আফ্রিকা মহাদেশ:
আফ্রিকার একটি বড় অংশ জুড়ে এই প্রথা প্রচলিত, বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা এবং উত্তর–পূর্ব আফ্রিকায়। যেসব দেশে এর হার সবচেয়ে বেশি, সেগুলো হলো,
সোমালিয়া: এটি FGM-এর সর্বোচ্চ হারের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রায় ৯৮% নারী ও মেয়েরা এই প্রথার শিকার।
* গিনি: এখানেও প্রায় ৯৭% নারী খৎনার শিকার হয়েছেন।
জিবুতি: প্রায় ৯৩%।
মালি: প্রায় ৯১%।
মিশর: যদিও এটি অবৈধ, মিশরে প্রায় ৮৭% নারী (১৫–৪৯ বছর বয়সী) খৎনার শিকার হয়েছেন। এটি আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, তাই ভুক্তভোগীর সংখ্যাও এখানে অনেক বেশি।
সিয়েরা লিওন: প্রায় ৯০%।
সুদান: প্রায় ৮৮%।
ইরিত্রিয়া: প্রায় ৮৯%।
বুরকিনা ফাসো: প্রায় ৭৬%।
গাম্বিয়া: প্রায় ৭৫%।
ইথিওপিয়া: প্রায় ৬৫%।
আফ্রিকা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কিছু দেশে এই প্রথা দেখা যায়।
একটি অমানবিক প্রথা
মেয়েদের খৎনা, যা নারীর যৌনাঙ্গ বিকৃতকরণ নামে পরিচিত, একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অমানবিক প্রথা। এই প্রথায় মেয়েদের যৌনাঙ্গের কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ অংশ কেটে ফেলা হয়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। পুরুষদের খৎনার সাথে এর কোনো তুলনা চলে না, কারণ পুরুষদের খৎনার (circumcision) কিছু স্বাস্থ্যগত সুবিধা থাকলেও মেয়েদের খৎনার কোনো স্বীকৃত স্বাস্থ্যগত সুবিধা নেই। বরং, এটি সারা জীবন ধরে তাদের জন্য শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মেয়েদের খৎনা কী?
মেয়েদের খৎনা হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো চিকিৎসা–সংক্রান্ত কারণ ছাড়াই মেয়েদের যৌনাঙ্গের বাইরের অংশ (external genitalia) আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলা হয়। এটি সাধারণত ছোট মেয়েদের বা শিশুদের উপর করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, কারণ এটি প্রায়শই অদক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা, অপরিষ্কার সরঞ্জাম দিয়ে এবং কোনো ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মেয়েদের খৎনাকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছে:
* টাইপ ১ (ক্লিটোরিডেক্টোমি): এই ধরনের খৎনায় ভগাঙ্কুরের (clitoris) কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ অংশ কেটে ফেলা হয়।
* টাইপ ২ (এক্সিজিয়ন): এখানে ভগাঙ্কুর এবং ছোট যোনী–ঠোঁট (labia minora) আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলা হয়।
* টাইপ ৩ (ইনফিউবুলেশন): এটি সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রকার। এতে ভগাঙ্কুর এবং ছোট ও বড় যোনী–ঠোঁট (labia majora) কেটে ফেলার পর যোনী–মুখ (vaginal opening) সেলাই করে প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধুমাত্র প্রস্রাব ও ঋতুস্রাবের জন্য ছোট একটি ছিদ্র রাখা হয়। এটি ‘ইনফিউবুলেশন’ নামে পরিচিত এবং এটি গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতার সৃষ্টি করা।
মেয়েদের খৎনার পেছনে কোনো ধর্মীয় বা স্বাস্থ্যগত ভিত্তি নেই। বরং এর মূল কারণগুলি হলো:
যৌনতা নিয়ন্ত্রণ: কিছু সমাজে এমন ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে মেয়েদের খৎনা করলে তাদের যৌন ইচ্ছা কমে যায়, যা তাদের “পবিত্র” ও “সতী” রাখতে সাহায্য করে। মনে করা হয়, এটি মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে দূরে রাখে।
সামাজিক প্রথা ও সংস্কৃতি: বহু সমাজে এই প্রথাটি একটি ঐতিহ্য হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসছে। এখানে এর সাথে মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া বা বিয়ের যোগ্যতা অর্জনের মতো বিষয় জড়িয়ে আছে। অনেক সময় এটি বিয়ের পূর্বশর্ত হিসেবেও দেখা হয়।
কিছু সমপ্রদায়ে এটি বিশ্বাস করা হয় যে খৎনা যৌনাঙ্গকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
ধর্মীয় বিশ্বাস: যদিও কোরআনে মেয়েদের খৎনার কথা উল্লেখ নেই, তবুও কিছু মুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে এই প্রথা চালু আছে।
মেয়েদের খৎনার সাথে যুক্ত স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং জটিলতাগুলো মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী। এর মধ্যে রয়েছে:
তাৎক্ষণিক জটিলতা, অত্যন্ত ব্যথা ও যন্ত্রণা। অতিরিক্ত রক্তপাত, যা জীবন–হুমকির কারণ হতে পারে। সংক্রমণ, যেমন টিটেনাস বা সেপসিস। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত ও ট্রমা। দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা, যৌন মিলনের সময় তীব্র ব্যথা এবং যৌন আনন্দ হারানো। ঋতুস্রাবের সময় রক্ত বের হতে অসুবিধা হওয়া, যা তীব্র ব্যথার কারণ হয়।
বন্ধ্যাত্ব বা গর্ভধারণে জটিলতা। প্রসবের সময় জটিলতা, যেমন প্রসব দীর্ঘায়িত হওয়া। মানসিক সমস্যা, যেমন উদ্বেগ , বিষণ্নতা।। যৌনাঙ্গে স্থায়ী ক্ষত এবং বিকৃতি।
মেয়েদের খৎনা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ কোটি মেয়ে ও নারী এই প্রথার শিকার হয়েছে। মিশর, সুদান, মালি, ইথিওপিয়া, সোমালিয়াসহ অনেক দেশে এই প্রথা এখনো বিদ্যমান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), জাতিসংঘ (UN), ইউনিসেফ (UNICEF) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মেয়েদের খৎনার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে এবং এটিকে নির্মূল করতে কাজ করছে। অনেক দেশেই এই প্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন, ২০০৮ সালে মিশর মেয়েদের খৎনাকে অবৈধ ঘোষণা করে, যদিও এটি এখনও গোপনে প্রচলিত।
মিশরে মেয়েদের খৎনার বিরুদ্ধে নারী অধিকার কর্মীদের ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উল্লেখযোগ্য। মিশর এমন একটি দেশ যেখানে এই প্রথা বহুকাল ধরে চলে আসছে, এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেখানকার নারীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।
এখানে মিশরের নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রচারাভিযান। মিশরের নারী সংগঠন এবং অধিকার কর্মীরা মেয়েদের খৎনার কুফল সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তারা বিভিন্ন প্রচারাভিযান পরিচালনা করেন, যেখানে এই প্রথার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির দিকগুলো তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
গণমাধ্যম প্রচার: টেলিভিশন, রেডিও এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা তথ্য প্রচার করেন। বিশেষ করে, খৎনার কারণে যেসব নারী দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন, তাদের গল্প তুলে ধরা হয়, যা সাধারণ মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে।
ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন (এফজিএম) নামে পরিচিত এই প্রথার কারণে নারীদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। সারা জীবন এই সমস্যা তাঁদের বয়ে বেড়াতে হয়। এসব সমস্যা সমাধানে যাঁদের ইতিমধ্যে খৎনা হয়েছে, তাঁদের যৌনাঙ্গ আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে মিসরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল। ইতিমধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে এই অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। অসংখ্য নারী এখন এই প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
অনেকের এখন অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যৌনাঙ্গ আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনায় তাঁকে নতুন করে আশা দেখাচ্ছে। অস্ত্রোপচারের পর সম্পূর্ণ আলাদা অনুভূতি পাচ্ছেন। এর শারীরিক প্রভাবের চেয়েও বেশি যেটা অনুভব করছেন, তা হলো, নিজের কাছে নিজের শরীরের দায়িত্ব থাকা।
এই প্রথা বৈশ্বিকভাবে নারীর মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও আইন প্রয়োগের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।