দেশে মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে দিন দিন এগুচ্ছে। ছেলেদের পেছনে ফেলে শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে মাধ্যমিক, উচ্চ ও বহুমুখী পেশাগত শিক্ষায় মেয়েরা সামনে চলে আসছে। একটি শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান জাতি গঠনে এটা সুখবর অবশ্যই। একমাত্র শিক্ষিত মা’ই একটি সুশিক্ষিত, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন দেশ ও স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনের মূল কারিগর। শিক্ষাক্ষেত্রে এই অগ্রযাত্রা প্রশংসনীয়। দেশ পরিচালনাসহ নানা বিশেষায়িত সেক্টরেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। সশস্ত্র বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, বিমানের পাইলট এমনকি ট্রেনের লোকোমাস্টারের মত স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়ও যুক্ত হচ্ছেন আমাদের মেয়েরা। পুরুষ সহকর্মীর সাথে অংশ নিচ্ছেন জাতিসংঘ শান্তি মিশনসহ মর্যাদাসম্পন্ন বৈশ্বিক দায়িত্বেও। নারীর এই দ্রুত অগ্রযাত্রা দেশ ও জাতির জন্য মস্ত সুখবর অবশ্যই। কারণ আমাদের জনসংখ্যা অর্ধেক নারী। তারা গৃহবন্দী হয়ে জাতি গঠন কাজ বা শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকলে পুরো জাতি পঙ্গু হয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই বাস্তবতা বুঝতে পেরে নারী শিক্ষা সহজ করতে প্রচুর ছাড় দেয়ার পাশাপাশি কর্ম সংস্থানেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নারীরা আজ দেশের বড় জনসম্পদে পরিণত হয়েছেন। যা দেশ ও জাতির জন্য নিশ্চিত সুসংবাদ।
কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি জরিপনির্ভর রিপোর্টে কিছুটা হতাশার ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। দীর্ঘ ৬ বছর পর প্রকাশিত জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়া, টিভি সংবাদ দেখা বা রেডিও শোনার ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এতে বলা হয়, মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ নারীর পত্রিকা- ম্যাগাজিন, টিভি বা রেডিওর প্রতি আগ্রহ আছে। অথচ ৬ বছর আগে পরিচালিত জরিপে এই সংখ্যা ছিল ১ দশমিক ৬ শতাংশ। বিপরীতে এই সময়ে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ। যা ৬ বছর আগে ছিল ৮২ শতাংশ। সারাদেশের ৬১ হাজার ২৪২ পরিবারে জরিপ চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছে বিবিএস। জরিপে প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নারীদের অন্যান্য বাস্তবতাও তুলে ধরা হয়েছে। বিবিএস এবং জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) যৌথভাবে ‘মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে-২০১৯’ নামে জরিপটি পরিচালনা করে। জরিপে মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহার বাড়ার তথ্য উঠে আসলেও ইন্টারনেট ব্যবহার করে মাত্র ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।
জরিপে নারীর অন্যান্য আরো কিছু সামাজিক অবস্থান সূচক তুলে আনা হলেও পত্রিকা ম্যাগাজিন না পড়া বা খবর বিমুখতার চিত্রটি খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। নারীর খবর পড়া বা দেখার নির্লিপ্ততার কারণ সম্পর্কে জরিপে কিছুই বলা হয়নি। সম্ভবত এটা জরিপের আওতায় ছিল না। না থাকলেও কেন মেয়েরা এত খবর বিমুখ তার কারণ অনুসন্ধান করাও জরুরি। প্রয়োজনে বিবিএস বা অন্য কোন জাতীয় সংস্থা বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার নিয়ে কর্মরত এনজিওগুলোর এ’নিয়ে পৃথক জরিপ কাজ চালানো উচিত। জানামতে বেশিরভাগ মেয়ে টিভি দেখেন। কিন্তু তারা ভারতীয় বাংলা বা হিন্দি সিরিয়ালে বেশি আসক্ত। যা তাদের মূল্যবান কর্মঘণ্টা এবং মেধার অপচয়। এ’ অবস্থায় হালনাগাদ তথ্য ও চলমান ঘটনা প্রবাহ থেকে দূরে থাকলে তারা নানা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে পারেন। পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ লাভের সাথে হাল নাগাদ তথ্য প্রাপ্তিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। নাহলে তারা গুজব বা বিকৃত তথ্য নির্ভর হয়ে পড়তে পারেন। যা তাদের প্রাপ্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহারে বড় বাধার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিষয়টা হাল্কাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। কারণ শিক্ষার হার বৃদ্ধি বা নানা পেশার কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়লেও জ্ঞান ও তথ্য বিমুখতা তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার বড় দায়টা এখনো নারীদের ওপর। তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে যদি তথ্য ও জ্ঞানের মেলবন্ধন গড়তে অপারগ হন, আগামী প্রজন্ম জ্ঞান বিমুখ প্রজন্ম হিসাবে গড়ে ওঠার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এটা জাতির জন্য কখনো সুসংবাদ হতে পারে না। নারী যে এগিয়ে যাচ্ছে, তার ধারাবাহিকতা আমাদের ধরে রাখতেই হবে।