‘ব্রেইন ড্রেন বা মেধা পাচার’ শব্দটি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ব্রিটেনে ব্যবহৃত হয়েছিল যখন উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো থেকে উন্নত দেশগুলোতে দক্ষ ও মেধাবী লোকদের অভিবাসন শুরু হয়েছিল। বৃটেনের রয়েল সোসাইটি মেধা পাচার বলতে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপে অভিবাসনকে বুঝিয়েছে। বস্তুত মেধা পাচার বা ব্রেইন ড্রেন একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু যা মানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়ার একটি অনুষঙ্গ। সাধারণত যুদ্ধ, সুযোগ–সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক সংঘাত বা অস্থিরতা, উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, নিজ দেশে যথাযথ কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা ইত্যাদি মেধা পাচারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। মেধা পাচারের কারণে একটি দেশ তার সবচেয়ে মেধাবী, জ্ঞানী, দক্ষ ও যোগ্য নাগরিককে হারায়, যেমনটি হারাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রের জন্য মেধা পাচার আজ এক অপরিহার্য বাস্তবতা ও অভিশাপ। কোন দেশ কতটুকু বিকাশমান তা নির্ভর করে সে দেশের মেধাবী তথা দক্ষ জনশক্তিকে কাজে লাগানোর কৌশলের উপর। মেধা পাচার সব ধরনের বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রে ঘটলেও ডাক্তার, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ প্রমুখ প্রধানত যাদের উপর দেশের অগ্রগতি নির্ভরশীল তারাই অধিকহারে দেশ ত্যাগ করে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। মেধা পাচারকে অনেকে মানব পুঁজি পাচারও বলে থাকেন। কেননা সাধারণ শিক্ষার্থীরাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে দেশকে এগিয়ে নিতে নিজে একজন সাধারণ মানুষ থেকে স্থায়ী পুঁজি বা মানব মূলধনে পরিণত হয়। ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, যে দেশ যত বেশি এই মানব পুঁজি সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিয়েছে সে দেশের অগ্রগতি তত ত্বরান্বিত হয়েছে। বহু দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েও দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে দারিদ্র্যের বেড়াজাল হতে মুক্ত হতে পারছে না। যেমন, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, সুদান, বলিভিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, মায়ানমার প্রভৃতি দেশ। অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদে অত্যন্ত দরিদ্র হয়েও জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, হল্যান্ড ইত্যাদি দেশ শুধুমাত্র মানব মূলধন কাজে লাগিয়ে বর্তমান বিশ্বে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে পৌঁছে গেছে।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও নিরেট বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি মেধাবীদের দেশ ত্যাগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। মেধাবী ও শিক্ষিত যুবকদের এখন প্রধান লক্ষ্যই যেন বিদেশে পাড়ি জমানো। অন্যান্য অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ সব স্তরের উচ্চ শিক্ষিত নাগরিকরা নিজেদের উন্নত জীবন গড়তে ইউরোপ ও আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে স্থায়ী বসবাসের লক্ষ্যে। সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিলের পরিচালনায় ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ শীর্ষ গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৫৫ শতাংশ মানুষ এর লক্ষ্য বিদেশে পাড়ি জমানো। ইউনেস্কো এর গ্লোবাল ফ্লো অফ টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস বিষয়ক এক রিপোর্ট এর তথ্য অনুযায়ী এক বছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫৭ হাজার ৬৭৫ জন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে পাড়ি জমিয়েছে যাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য সেসব দেশে ক্যারিয়ার গড়ে তোলা।
এখন প্রশ্ন হল, কেন মেধা পাচার হয়? শুধু উচ্চ বেতন কিংবা বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্যই কি মানুষ স্থায়ীভাবে দেশ ছাড়তে চায়? একটু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বহুবিধ কারণে মেধাবীরা এ দেশ ছাড়ছে, যাদেরকে দেশের মায়া কিংবা দেশপ্রেম টানছে না। বাংলাদেশ থেকে মেধা পাচারের অন্যতম কারণ হলো এদেশে মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। বহু বিশ্লেষকের মতে, অতীতে দেখা গেছে বাংলাদেশে মেধার চেয়ে দলীয় আনুগত্য, চাটুকারিতা, কালো টাকা, পেশী শক্তির প্রভাব প্রভৃতির মূল্যায়ন অনেক বেশি। মেধা পাচার এর আরেকটি কারণ হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। আইনের শাসনের অভাবে মেধাবীরা দেশের প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। উন্নত দেশের আইনের শাসন এদেশের মেধাবীদেরকে আকৃষ্ট করে। এছাড়া উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ এদেশের মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য ফুল স্কলারশিপসহ উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ অবারিত করে দিয়েছে। অনুরূপভাবে অনেক মেধাবী দম্পতি সন্তানদের নিরাপদ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
মেধাবীদের দেশ ত্যাগের অন্যতম একটি বাস্তব কারণ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ উচ্চশিক্ষিত তরুণ তরুণীর যথাযথ কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা এদেশে এখনও হয়ে ওঠেনি। বাধ্য হয়ে এ সমস্ত মেধাবীরা পৃথিবীর যে দেশেই সুযোগ পাচ্ছে দেশ ছেড়ে সে দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, ছোট্ট এ জীবনকে সফল করার জন্য। বলাবাহুল্য, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোন গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যুক্তিভিত্তিক সমাজ নির্মাণের অনুষঙ্গগুলো সঠিকভাবে বিকশিত হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো অগণতান্ত্রিক ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে পরিচালনা করার পুনঃ পুনঃ চেষ্টা গণতন্ত্র থেকে দল ও দল ব্যবস্থাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে দেশে কি রাজনীতিতে, কি প্রশাসনে, কি গবেষণায়, কি জীবন আচরণে কোথাও মেধাবীদের ভূমিকা রাখার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে এদেশের মেধাবী লোকজন ও যুবসমাজ বিদেশে পাড়ি জমানোকেই নিরাপদ ও অপরিহার্য বাস্তবতা হিসেবে মনে করছে। পরিণামে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, পিছিয়ে পড়ছে স্বপ্নের বাংলাদেশ। ২০২৪ এর জুলাই আগস্ট এর গণ অভ্যুত্থানে এত বিপুলসংখ্যক ছাত্র যুবকদের অংশগ্রহণ মূলত যে বার্তা রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দল ও দল ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছুঁড়ে দিয়েছে তার যথাযথ মূল্যায়ন এখনো এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দলসমূহ আমলে নিচ্ছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
দেশ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে বিপুলসংখ্যক মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত যুবক বিদেশে পাড়ি জমানো দেশের জন্য যে বিরাট ক্ষতি সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই কারো দ্বিমত নেই। একদিকে বিপুল শিক্ষিত মেধাবী জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এদেশ করতে পারছে না, ফলে তারা বাধ্য হয়েই দেশ ত্যাগ করছে। অন্যদিকে প্রায় তিন লাখের বেশি বিদেশি এদেশে উচ্চ বেতনে কাজ করছে এবং নিজ নিজ দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার এক বিরাট অংশ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশ জনবহুল একটি রাষ্ট্র, স্বভাবতই এ দেশ থেকে দক্ষ শ্রম শক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য যেতে পারেন এবং পাঠানো উচিত। এসব শ্রমিকরা অবশ্যই একেক জন গুরুত্বপূর্ণ রেমিটেন্স যোদ্ধা। তাদের ঘাম ঝরা শ্রম দিয়ে এদেশে যে রেমিটেন্স আসে তা অবশ্যই দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। কিন্ত গবেষণায়, নীতি নির্ধারণে, চিকিৎসা সেবায়, প্রকৌশল সেক্টরে মেধাশূন্য করে সে জায়গায় বিদেশিদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া মানে এদেশের মানুষের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচারের ব্যবস্থা করা। তাই দেশের উদ্বৃত্ত জনশক্তিকে বিদেশে পাঠানো আর মেধা পাচারকে একসাথে গুলিয়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, রাষ্ট্র ও সমাজে সত্যিকার গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিমূলক ও যুক্তিভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে, আইনের শাসনকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে, পরিকল্পিতভাবে মেধাবীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে এ দেশ যেমন সমৃদ্ধ হবে না তেমনি মেধা পাচারও ঠেকানো যাবে না।
লেখক : অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কায়সার নিলুফার কলেজ। প্রধান উপদেষ্টা, রাজনীতি বিজ্ঞান অনুশীলন কেন্দ্র, চট্টগ্রাম।