‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ।
কিন্তু পাহাড় কে বিক্রি করে তা জানি না।
যদি তার দেখা পেতাম,
দামের জন্য আটকাতো না।
আমার নিজস্ব একটি নদী আছে,
সেটা দিয়ে দিতাম পাহাড়টার বদলে।’
সাজেক ভ্যালিতে বেড়াতে গিয়ে আমার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পাহড় চূড়া’ কবিতার প্রথম ক’টি লাইন মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশের প্রায় পার্বত্য জেলাগুলোর অধিকাংশ এলাকা বহুবার ঘুরেছি। কেবল বাকি ছিল ভ্রমণস্পট সাজেক ভ্যালি। বহুবার পরিকল্পনাও করেছিলাম। নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। এবার যখন সুযোগ পেলাম, সঙ্গী হলাম আমিও। প্রকৃতির অপরিমেয় দান পাহাড় আর সমুদ্র। কোনটি বেশি টানে, পাহাড় না সমুদ্র? এই তর্কে আমি বরাবরই চুপ থাকি, কেননা দুটোই আমাকে সমানভাবে টানে। পাহাড় আমাকে শেখায় যার উচ্চতা যতো বেশি, তার শূন্যতা ততোই বিশাল। রাঙামাটির ফুরামন পাহাড়, বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়, ডিম পাহাড়, নীলাচল , নীলগিরিতে বার বার গিয়েছি। কিন্ত সাজেকে এবার প্রথমবার গিয়ে যখন পাহাড়মালার সাথে মিতালী করছিলাম, ছিল অন্যরকম ভালো লাগা, প্রথম একটি নতুন জায়গা দেখা, অনেকটা প্রথম প্রেমে পড়ার শিহরণ যেনো। চট্টগ্রাম শহর থেকে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল খাগড়াছড়ি। সেখানে একরাত কাটিয়ে পরের দিনে সাজেকে যাত্রার পালা। সাজেক কিন্তু রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। এর উত্তর সীমান্তে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম আর পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দিঘীনালা। সাজেক পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফিট। আর চট্টগ্রাম শহর থেকে সাজেকের দূরত্ব ১৯৫. ৭ কিলোমিটার। সাজেক আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন,যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। রুইলুইপাড়া ও কংলাক পাড়া এই দুটি পাড়ার সমন্বয়ে সাজেক বিস্তৃত। এখানে মূলত লুসাই, পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীই বাস করে। রাঙামিিটর অংশ হলেও সাজেকে যাবার মূল পথ খাগড়াছড়ি হয়েই। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। আর দিঘীনালা থেকে ৩৯ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ পাহাড়ি পথ নিরিবিলি আর নির্জনতায় ভরা। ফলে নিরপত্তার কারণে সাজেকে যাত্রীদেরকে দিঘীনালা থেকে আর্মি স্কট দিয়ে যেতে হয় এবং ফিরতে হয় একইভাবে। প্রতিদিন যাত্রী সাধারণের জন্য সকাল ১০ টায় আর্মি প্রটেকশন থাকে যাত্রাকালে। আবার ফেরার সময়ও একই প্রটেকশনে ফিরতে হয়। আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে প্রথম যাত্রা শুরু করি আমাদের ৯ জন সফরসঙ্গীর দলনেতা সাংবাদিক এজাজ মাহমুদের নেতৃত্বে। দলে সবাই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। সবাই আবার বন্ধু। বন্ধুবর গ্রুপের মেম্বার। দলনেতা এজাজ দম্পতি, কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী দম্পতি, কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল দম্পতি আর নাট্যশিল্পী শুভ্রা বিশ্বাস, ফ্যাশন ডিজাইনার আইভি হাসান আর আমি। একটি মাইক্রোতে যাত্রাকালে কথা, আড্ডা, গল্প হা হা হি হি করতেই করতেই পৌঁছে গেলাম মানিকছড়ি। সেখানে থানায় রিফ্রেশমেন্ট সব অর্গানিক ফলের রস, আর রসালো ফলের আপ্যায়ন। এরপর গুইমারা হয়ে খাগড়াছড়িতে চমৎকার রেস্ট হাউজে উঠলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে বিকালে খাগড়াছড়ি হাজারী বুদ্ধমূর্তি, হট্টিকালচার সেন্টার ঘুরে রাতে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। আবৃত্তি আর গানে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, আর খাছালং পাহাড়চূড়ায় দারুণ রাতের ভোজ। সব মিলিয়ে স্মরণীয় একদিনের খাগড়াছড়ি ট্রিপের পরিসমাপ্তি। পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে চাঁদের গাড়িতে করে যাত্রা সাজেকের উদ্দেশ্যে। দিঘীনালা হয়ে সাজেকে পৌঁছাতে দুপুর গড়ালো। বাঘাইছড়ি থানায় উদরপূর্তি করে সাজেকে বুকিং করা নিরিবিলি রিসোর্টে প্রবেশ। সম্পূর্ণ কাঠ , বাঁশ আর শন দ্বারা নির্মিত রিসোর্টটি এক কথায় অসাধারণ। পাহাড়ের ঊঁচু চূড়া থেকে পাদদেশে গিয়ে থেমেছে রিসোর্টের কক্ষগুলি। কাঠের সেতুর মতো সিঁড়িগুলো খুবই সুন্দর। কিন্তু বৃষ্টির কারণে এই কাঠ পিচ্ছিল হয়ে পথ চলতে কিঞ্চিৎ অসুবিধা হয়েছে আমরা সবাই বয়সে ভারি বিধায়। কারো পায়ে, কারো কোমরে , কারো হাতে কারো মাথায় একটু আধটু সমস্যাতো থাকবেই। তবে তরুণদের জন্য এটি চমৎকার রোমান্টিকতায় ভরা। আর কটেজের অদূরে মিজোরাম পা্হাড়ে মেঘমালারা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল। আমরা বিকালে কটেজ থেকে সাজেক দেখতে বের হলাম। হ্যালিপ্যাড, কংলাক পাহাড় ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে আসছিল। পথের দুপাশে আদি রমনীদের বিকিকিনির পশরা। গরম গরম মোমোর ঘ্রাণ, আদা চা, তেঁতুল চা আর বাঁশ আর বেতের সামগ্রীর ছোট্ট হাট। ঘুরতে ঘুরতেই এলো ঝুম বৃষ্টি। অতপর চাঁদের গাড়িতে কাকভেজা হয়ে ভিজতে ভিজতেই কটেজে প্রবেশ। বৃষ্টি থামলেই মনটানায় রাতের খাবার খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা আর গল্পশেষে পোকামাকড়ের গান শুনতে শুনতেই চলে গেলাম ঘুমের রাজ্যে। সকালে আবার মনটানায় চমৎকার ব্রেকফাস্ট সেরে এক ঝলক সাজেক ঘুরে প্রত্যাবর্তন খাগড়াছড়ির পথে। এই ফাঁকে শত শত ফটোসেশন। কখনো বৃষ্টিভেজা সাজেকভ্যালি, কখনো দিগন্তবিস্তৃত মেঘমালা, কখনো ঢেউখেলানো শৈলশ্রেণী নতুবা অনেক নীচে প্রবহমান ক্ষীণ পাহাড়ি ঝর্ণধারা। আর কলা আম আনারস , পেঁপে এমনকি বেতফলও বাদ পড়েনি আমাদের রসনা থেকে। এই ফল দেখে জীবনানন্দ দাশের ‘হায় চিল’ কবিতা মনে এল।
‘তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে…’
এবার পাহাড়মালা ছেড়ে নেমে আসার পালা। পথে পেলাম একটি ছোট ত্রিমোহিনী খাল। ইচ্ছে হয়েছিল, এক্ষুনি তার শীতল জলে ঝাঁপ দিয়ে মেতে উঠি ডুবসাঁতারে। তা কি আর হয়। চোখ দিয়ে দেখেই যতখানি মুগ্ধ হলাম, সেটিই তো পরম পাওয়া। চলতে চলতে আবার খাগড়াছড়ির সেই সুরম্য রেস্ট হাউজ, সেখান থেকে আলুটিলার কাছে আরেক নৈসর্গিক রেস্টহাউজে দুপুরের সব পাহাড়ি রেসিপির মজাদার খাবার খেয়ে যাত্রা বাড়ির পথে। ফিরতে ফিরতেই গাড়িতে আবার গল্প, আড্ডা আর খুনসুটি ! সন্ধ্যায় যখন ফটিকছড়ি প্রবেশ করলাম, পাখিরা নীড়ে ফিরছে। কি যে কলকাকলি তাদের, কিচিরমিচির গান অসাধারণ লাগলো। সেই পাখিদের কলতান, সেই পাহাড়ি নির্জন আমেজ আর সবুজের সমারোহ ছেড়ে যখন শহরে প্রবেশ করছিলাম, পথে পথে গরুর হাটের বিড়ম্বনা। ফলে কষ্ট হলো এই সফরের মূল আয়োজক এজাজ মাহমুদের। একেক জনকে স্ব স্ব স্থানে নামাতে নামাতে তিনি হয়তো যখন বাসায় ফিরলেন, তখন রাতের এক প্রহর প্রায় শেষের দিকে। তবে এই চমৎকার সফর আমার কাছে স্মরণীয় থাকবে চিরকাল।