মেঘের নাম মরিয়ম

আরিফুল হাসান | শুক্রবার , ৭ জুন, ২০২৪ at ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ

বৃক্ষের কাছে প্রশ্ন রেখেছি, ‘মানুষের বুকের ভেতরে কিছু মেঘ থাকে। কী নাম দেয়া যায় সেসব মেঘের?’ বৃক্ষ নীরব থেকে রাতের মতো স্তব্ধস্বরে বললো, ‘নীরবতাই মহত্ব। মেঘে মেঘে যখন ঘর্ষণ লাগে, বিদ্যুৎ হয়, ভালো কথা। কিন্তু বজ্রপাতও হয়।’ আমি বললাম, ‘দুঃখ, সে তো আমার চিরন্তন প্রেমিকা।’ বৃক্ষ বললো, ‘এসব ভেবে লাভ নেই, চলো বাদাম খাওয়া যাক।’ আমি বললাম, ‘বাদামও তো বৃক্ষজাত।’ বৃক্ষ উত্তর দিলো, ‘তোমরা মানুষ হয়ে যদি মানুষ হত্যা করতে পারো, আমি বৃক্ষ কেনো পারবো না?’

আমি সে প্রশ্নের উত্তরে নির্বাক, নিরুত্তর থেকেছি। গাছ বললো, ‘থাক, বাদাম খাওয়া বাদ যাক, চলো খেলা করি।’ আমি বললাম, ‘একটু আগেই তো তুমি রাতের ভাষায় কথা বললে, বললে নীরবতার মহত্ব। এখন এমন বাদাম খাওয়া, খেলা করতে চাওয়াএসব কী?’ বৃক্ষ বললো, ‘রাত কী ভোর হয় না? আমি বললাম, ‘হয়। কিন্তু রাতকে যে রাতের মতো ভাঙতে হয় আর দিবসকে দেখতে হয় দিবসের অন্তরালে। তাহলে সূর্য যে পূবদিকে উঠে তার উপর আস্থা কোথায়। গোলাকার পৃথিবীতে ঘূর্ণায়মান দিকনির্ভরতা কিসে?’ বৃদ্ধ বৃক্ষ বললো, ‘বুঝলাম, তোমার দিকজ্ঞান নেই।’ আমি বললাম, ‘দিকজ্ঞান আমার আছে; দিকজ্ঞান তোমার নেই।’ বৃক্ষ হেসে বললো, ‘আমি কিন্তু রাগ করিনি।’ আমি বললাম, ‘কেনো? কেনো তুমি রাগ করোনি?’ বৃক্ষ বললো, ‘এই যে তুমি আমার ছায়ায় জিরোচ্ছো, আসলে জিরোচ্ছো কি?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি জিরোচ্ছি।’ বৃক্ষ বললো, ‘তাহলে কথা বলছে কে?’ আমি বললাম, ‘আমি।’ ‘উত্তর ঠিক আছে।’ বৃক্ষ বললো। আরও বললো, ‘তুমি তাহলে জিরোচ্ছো না।’ আমি বললাম, ‘জিরোচ্ছি তো।’ ‘মিথ্যে কথা’, বৃক্ষ বললো।

আমি চাঁদের বুকে চাঁদ রেখে প্রশ্ন করলাম, ‘ও চাঁদ, তুমি কেনো আমার নও।’ চাঁদ বললো, ‘আমি তো তোমারই। তুমি চেনো না?’ আমি বললাম, ‘না, আমি তোমাকে চিনি না, আমিও তোমার কাছে অচেনা।’ চাঁদ বললো, ‘এই যে জ্যোৎস্নাশোভিত রাত, তুমি উপভোগ করছো। এই রাতের অংশ, এই জানালা অথবা আধখোলো দরোজা। তুমি কি তার ভেতরে উন্মোচিত হও?’ আমি বললাম, ‘হই তো, না হলে এমন ভুলভাল শব্দে তোমাকে ধরতে চাই কেনো? আসলে, তুমি তো অধরাই, তাই না?’ ‘চাঁদ অধরা থেকে যায়,’ চাঁদ বললো, ‘হ্যাঁ, তুমি মানুষ। তুমি কি কৃত্রিম সাইক্লোনে চাঁদের বুকেও ধ্বংসাত্মক হতে চাওনি? নিভিয়ে ফেলতে চাওনি বাতি?’ ‘বাতি নিভিয়ে ফেললে চাঁদের বুকে মোমবাতি তেলেসমাতি দেখাবে কে?’ আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম। চাঁদ বললো, ‘বাতি নিভিয়ে ফেলা কি ভালো মানুষের কাজ, অথবা অগ্নি প্রজ্বলন?’ আমি বললাম, ‘আগুনেরও কিছু দুঃখ থাকে।’

গাছের কাছ থেকে ফিরে চাঁদের কাছে প্রশ্ন রেখেছি, ‘মানুষের বুকের ভেতর কিছু মেঘ থাকে। কী নাম দেয়া যায় সেসব মঘের?’ চাঁদ বললো, ‘শীতলতাই সর্বোত্তম পন্থা।’ আমি বললাম, ‘তাহলে কী নদীতে জোয়ার ভাটা হয় না তোমার টানে?’ চাঁদ বললো, ‘জোয়ার ভাটা হয়; তবে তা আগুনের উত্তাপ তো নয়? জলের কল্লোল।’ আমি লাল ফুলের মতো বিদ্রোহী হয়ে বললাম, ‘জলজ সন্ত্রাস জলসেচনে ভয়াবহ।’ চাঁদ বললো, ‘চিরকালই দুর্নীতিপরায়নরা এমন হয়। তারা জল হয়েও জলোচ্ছ্বাস হয়। আর আমার বুকেও হতে চায় ঘূর্ণি। আমি বললাম, ‘আলোকবর্ষ দূরে সে দুঃখ কি তুমি টের পাও?’ চাঁদ বললো, ‘আমাদের দূরত্বটা বুঝি না। চলো, রাত খাই।’ আমি বললাম, ‘আহা, তুমিও তো নিশাচর!’ চাঁদ বললো, ‘তাতে সমস্যা কী? তুমি মানুষ হয়ে মানুষ হত্যা করতে পারো, আমি নিশিবিলাসিনির সুরে সামান্য নাজেহাল হলে তুমি এমন ভেঙে পড়ো কেনো?’ আমি বললাম, ‘ভেঙে পড়ি কি আর এমনিতে, যখন রাত ভাঙে অন্ধকারে খানখান, আর আমি টুকরো টুকরো হয়ে যাই, তখন তুমিই তো বললে জমাটবদ্ধ বরফের শীতলতা। চাঁদ বললো, ‘আসলে মিথ্যেবাদী তুমি। তুমিই আমার হতে পারোনি।’

.

রাতকে বললাম, ‘অন্ধকারের কি নিজস্ব কোনো আলো নেই?’ রাত বললো, ‘এ আবার কী বোকামি কথা! অন্ধকারে আলো খোঁজার চেষ্টা কেনো?’ আমি বললাম, ‘নিছক কৌতূহল। আর আমি পড়তে চাই এমন কোনো ভাষা, যা কোলাহল নয়।’ ‘আর কিছু?’ রাত প্রশ্ন করলো। ক্ষণিক মৌন রইলাম আমি। ‘কিছু কি লুকোচ্ছো? গোপন করছো কিছু, এমন কিছু, যা তোমার গোপনে আছে, অথচ তুমি প্রকাশ করতে চাও না? এমন কিছু থাকলে নিশ্চয় বলো। বলতে দ্বিধা কেনো?’ আমি বললাম, ‘দ্বিধা থাকবে কেনো? না, নেই তো?’ ‘তোমার এ বলার মধ্যেও দ্বিধা। প্রশ্ন করছো না উত্তর দিচ্ছো নিশ্চিত হতে পারছো না।’ রাত বললো। তারপর বললো, ‘ব্যাপার না, চলো অন্ধকারকে তছনছ করে ফেলি।’ আমি বললাম, ‘হে রাত, তুমিও তো স্বপ্নচারী।’ রাত বললো, ‘তাতে সমস্যাটা কোথায়? তুমিও তো মানুষ, আর মানুষ হয়ে হত্যা করো মানুষকে। আমিও রাত হয়ে অন্ধকারের গলা চেপে ধরি যদি, তুমি তাতে সমস্যা খুঁজবে কেনো?’ আমি বললাম, ‘না, সমস্যা খোঁজার আমার দরকার নেই। আমি বরং চুপচাপ রাতকে উপভোগ করি।’ রাত বললো, ‘উপভোগেও তো নিঃশেষ হয় নক্ষত্র।’

রাতকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি জানো, মানুষের বুকের ভেতরও কিছু মেঘ থাকে? কী নাম সে মেঘেদের? জানো কি?’ রাত বললো, ‘না, জানি না। আর জানলেও বলবো কেনো? জানবোও কেনো? আমি কি মেঘ দেখি? মেঘে মেঘে অন্ধ হয়ে কখনো আকাশ ছুটে আমার দিকে।’ ‘গোলার্ধ্ব ভেদে কিন্তু তুমি সুন্দর।’ আমি । রাত আমাকে বলে, ‘তুমি সুন্দর মানে? কী বলতে চাও নিজেকে? অসুন্দর?’ ‘না, আমি নিজেকে অসুন্দর ভাবছি না।’ উত্তর দিলাম আমি। রাত বললো, ‘তুমি অন্ধকারের চেয়েও কুৎসিত। আঁধার তোমাকে ভর্ৎসনা করে, তিরস্কার করে তোমার পাপের। তুমি নিছক দূর হও।’

.

আমি সবার কাছ থেকে ফিরে এবার নিজের দিকে চাইলাম। বললাম, ‘তুমি কি খুনি, মানুষ হয়ে খুন করেছো অন্য মানুষকে কখনো?’ নিজের ভেতর থেকে কোনো উত্তর পেলাম না। ভেতরের ভাষাগোষ্ঠী কেমন বিচ্ছিন্ন হতে থাকলো দিগ্বিদিক, বর্ণমালারা কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না, ধ্বনি পেলো না বর্ণচিহ্ন, জমাট এক স্তব্ধতা আমাকে পাথর করে দিলো। আমি আবারও প্রশ্ন করলাম, ‘চুপ করে থেকো না, বলো, দ্বিধা ভয় কাটিয়ে বলো, নিজের কাছে নিজে জবানবন্দি দাও, বলো, তুমি কি খুনি?’ আমার ভেতরের আমি বলে উঠলো, ‘আসলে তুমি খুন করেছো নিজেকেই।’

আমি আমাকে প্রশ্ন করলাম ‘বুকের ভেতরে কিছু মেঘ থাকে। সে মেঘমালার নাম কী দেয়া যায়?’ আমার ভেতরের আমি বললো, ‘না, তুমি উত্তর খুঁজছো না। এ নিছক প্রশ্ন, প্রশ্ন তোলার জন্য প্রশ্ন। বলতে পারো গল্প বলার ছল। আসলে তো এমনি। নাহলে দেখবে না কেনো যে তোমার বৃক্ষমগ্নতা আসলে বকধ্যান, তোমার জ্যোৎস্নাবিহার আসলে প্রজ্জ্বলিত আগুন, আর তোমার রাতভাষা আসলে অন্ধকারের সমাহার। যদি এমন না হতো, তাহলে দেখতে, বৃক্ষও সবুজ পাতা দেয়, দেখায় জীবন। দেখতে, চাঁদের শীতলতা বরফ নয়, কোমল উজ্জ্বল স্বপ্ন, আর দেখতে দুঃখের রাত শেষে সত্যিই আসে সুখের ভোর। আমি বললাম, ‘তাহলে এতকাল দেখলাম না কেনো?’ আমার ভেতরের আমি বললো, ‘আসলে তুমি তুমি ভুল জানতে, মানুষের বুকের ভেতরে নয়, মাথার ভেতরে থাকে কাশফুলের মতো শাদা মেঘ।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধযুগাবতার নজরুল