আকাশে মেঘের দেখা নেই। চড়ারোদে ক্ষতি হচ্ছে সবজি চাষের। তীব্র তাপ প্রবাহের জেরে শুকিয়ে যাচ্ছে গাছের পাতা। বাড়ছে রোগ পোকার আক্রমণ। গাছের পাতা হলুদ হয়ে যাওয়ায় ফসলের উৎপাদনও কমার আশঙ্কা রয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে মালিহার সমস্ত শ্রম বিফলে যাবে। এবার তার বড় ধরনের সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধারদেনা করে আর শরীর খাটিয়ে যেটুকু আশা নিয়ে নিজের স্বল্প জমিতে চাষবাস শুরু করেছিল, কিন্তু ভাগ্য তার সঙ্গে পরিহাসপ্রিয়। তবু মালিহা নিজের হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। সকাল থেকে এই পর্যন্ত কাখে পানির কলস টেনে প্রতিটি গাছের গোড়ায় ঢেলেছে। একটি গাছ বাদ রাখবে না আজ। সবগুলো গাছের শুষ্ক খনখনে মাটি নরম কাদায় পরিণত করে তবেই সে ক্ষান্ত হবে। রাইসুল বলল, তাপপ্রবাহের জন্য দেশ জুড়ে সবজির ফলন কম তো হচ্ছেই, দেশে বহু সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। প্রচন্ড রোদে ফসলে রোগের উপদ্রবও বাড়ছে।
মালিহা কিছু বলল না। চুপচাপ নিজের কাজে মন দিল। রাইসুল কলেজে শিক্ষকতা করে। মালিহার আর তার বাড়ি পাশাপাশি। দুজনের সম্পর্ক চাচাত ভাইবোন। মালিহাকে সবজি চাষের বুদ্ধিটা রাইসুলই প্রথম দিয়েছিল। তার মতো মালিহাও শিক্ষকতা করতো, কিন্তু হাই স্কুলে। শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে কৃষি খাতে সময় ব্যয় করায় শুধু পারিবারের লোকজনই না, গ্রামসুদ্ধ টাশকি খেয়ে গেছে। এমন শিক্ষিতা, রূপবতী, গুণবতী মেয়ে সম্মানের চাকরি ছেড়ে মাঠে মাটির কাজ নিয়ে পড়ে থাকবে এটা বোধহয় কেউ ভাবেনি। তবে আপত্তি করেছিল বহু ে লোক। নিজের পরিবারের লোকজন ছাড়াও বিশেষ করে রাইসুলের মা–বাবার ঘোর আপত্তি তাতে। তাদের হবু বউ ক্ষেত খামারে কাজ করবে এমন ভাবা যায়?
রাইসুল বলল, আজ ৩৭ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠে গেছে। যদিও গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষে ৩০–৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় ফসলের কোনো ক্ষতি হয় না। অথচ দেখো এই সময় কালবৈশাখী–সহ ব্যাপক ঝড়–বৃষ্টি হয়। ফলে বেশি তাপমাত্রা থাকলেও ফসলের ক্ষতি হয় না। কিন্তু এবারে তাপমাত্রা অন্যবারের থেকে ৪–৫ ডিগ্রি বেশি। সঙ্গে কালবৈশাখীরও দেখা নেই। ঝড় হলে গাছ থেকে সব পোকা পড়ে যায়। ফলে ক্ষতিও কম হয়। তবে এবারে ঝড়–বৃষ্টি কম হওয়ায় তোমার ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
কলসির পানি সবটুকু ঢেলে মালিহা বলল, প্রফেসর সাহেব, এখানে দাঁড়িয়ে লেকচার না দিয়ে ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের পড়ান। তাতে আপনার ছাত্রদের উপকার হবে, আর আমার সম্মানও বাঁচবে।
রাইসুল চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বলল, তুমি আমার হবু বউ। তোমার পাশে সারাদিন বসে থাকলেও কেউ কিছু মনে করবে না।
মালিহা ছদ্ম রাগের সুরে বলল, কিন্তু প্রফেসর সাহেব আপনি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মাথা খাচ্ছেন। আর জ্ঞান দিচ্ছেন যেন আমি কিছুই জানি না। একেবারে আনাড়ি।
রাইসুল লাজুক ভঙ্গিতে বলল, না না তুমি আনাড়ি হবে কেন? বরং আমার জন্যই তো তুমি নিজ হাতে ফর্মালিন ছাড়া সবজি চাষ করছো। তুমি জানো আমি বাজারের সবজি খেতে পারি না। রোদে পুড়ে আমার জন্য ফসল ফলাচ্ছ। এটা তো আমার প্রতি তোমার তীব্র ভালো লাগার নিদর্শন।
মালিহাও লাজুক ভঙ্গিতে বলল, প্রফেসর সাহেব, আমি এ বছর কী কী সবজি চাষ করব শুনবেন? পটল, ঝিঙে, ঢ্যাঁড়শ, শশা, করলা, বেগুন, লাউ, কুমড়া আর বরবটি।
কার সঙ্গে কথা বলছিস মালিহা?
যিনি প্রশ্ন করেছেন লোকটি মালিহার প্রতিবেশী। রাইসুলের বাবা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন তিনি মেয়েটির মুখের পানে। কী অপরূপ মেয়ে ছিল ও, আর কী হয়ে গেল! ছেলের বউ করতে চেয়েছিলেন। ডেঙ্গু জ্বরে ছেলেটি মারা গেল। সেই শোকে মাথাটাই খারাপ হয়ে গেল মেয়েটির। দিনরাত মাটির কাছে পড়ে থাকে। মাটির সাথে কথা কয়। কী কয় তাও জানে। রাইসুলের বাবা চোখের কোনায় পানি মুছে হেঁটে চললেন। এখনও তার কানে আসছে, মালিহা বিড়বিড় করে বলল, তীব্র তাপের জেরে এই সব সবজিতে মাকড় জাতের শোষক পোকা, সাদা মাছি, বালি পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকার উপদ্রব বাড়ছে। ওই সব পোকা গাছের পাতার রস শুুষে নিচ্ছে। পাতা হলদু হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। তাপে শুকিয়ে যাচ্ছে গাছের গোড়াও…।