মৃত্যু এক অবধারিত সত্য

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২৫ at ৯:১৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষ চিরঞ্জীব নয়, মহান আল্লাহতায়ালাই একমাত্র চিরঞ্জীব। প্রত্যেক জীবকে মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এটা এক অবধারিত সত্য কথাতাতে কোন সন্দেহ নেই। ‘প্রত্যেক প্রাণী মরণের স্বাদ ভোগ করবে, তোমাদের পাওনা কেয়ামতের দিন পুরোপুরি আদায় করে দেওয়া হবে, যাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে দেওয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সেই সফলতা পাবে। এই পার্থিব জীবন ছলনার মাল সামানা ছাড়া আর কিছুই নয়’সূরা ইমরান১৮৫। মৃত্যু এমন একটা জিনিস যা কারো সাথে শেয়ারও করা যায় না। হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত যত নবী রাসূল (সাঃ) আল্লাহতায়ালা প্রেরণ করেছেন সবাইকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে। এই অমোঘ সত্য থেকে নিজেকে কেউ বাঁচাতে পারেনি। হযরত আজরাইল তথা মালাকুল মাওতসবশেষে উনাকেও মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব ও শেষ নবী সাইয়্যিদেনা মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে মৃত্যুর কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। খাইবারের যুদ্ধে এক ইহুদী নারীর দাওয়াত খেতে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) পেটের প্রচন্ড পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এই পীড়া তাঁকে কয়েকবার প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছিল। অতঃপর তিনি মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। পেটের পীড়ায় যখন তিনি কাতরাচ্ছিলেন তখন তাঁর নয়নের মণি হযরত ফাতেমা (রাঃ) ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছিলেন। পরে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁকে ডেকে ফিস ফিস করে কি যেন বললেন, এটা শুনার পর হযরত ফাতেমা (রাঃ) অঝোরে কাঁদলেন, পরবর্তীতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আবার কি যেন বললেন, এবার তিনি হেসে দিলেন। হযরত মা আয়েশা (রাঃ) এটার কারণ জিজ্ঞেস করার পর হযরত ফাতেমা (রাঃ) বললেন, ‘প্রথম দিকে যখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমার সাথে কথা বলছিলেন, তখন তিনি বললেন, আমি খুব তাড়াতাড়ি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাব, তখন আমি কাঁদলাম, আবার আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয়বার বললেন, ওফাতের পর তোমার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হবে, তখন আমি হেসে দিলাম’। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওফাতের মুহূর্তে শেষ কথা ছিল-‘ইয়া উম্মতি সালাত সালাত এবং অধীনস্থ কর্মচারীদের ঘাম শুকানোর আগেই তাদের মজুরী দিয়ে দাও’। মৃত্যু যখন আসবে সেখান থেকে কেউ রেহাই পাবে না, ‘কারো নির্ধারিত সময় যখন এসে যাবে তখন আল্লাহতায়ালা কখনও তাকে অবকাশ দিবেন না। তোমরা দুনিয়ার জীবনে যা কিছু করছ আল্লাহতায়ালা সেই সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত রয়েছেন’। মানুষ যেখানেই থাকে না কেন আল্লাহর নির্দেশ পেলেই মালাকুল মাওত সেখানে গিয়ে তার জান কবজ করবেন। হযরত ইদ্রীস (আঃ) এর জান কবজ হয়েছিল চতুর্থ আসমানে। জান্নাতী মানুষদের মৃত্যু হবে অত্যন্ত সহজ আর জাহান্নামী মানুষের মৃত্যু হবে অত্যন্ত কঠিন। দেহ থেকে জান্নাতিদের রুহ বের হবে অত্যন্ত ধীরে ধীরে এবং তা রুহের জগতে চলে যায়। আল্লাহতায়ালার নির্দেশে জান্নাতীদের শরীরে জান্নাতী পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয় এবং জান্নাতীদের কবর ৭০ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে যায়। আল্লাহর নির্দেশে কবরের সাথে সরাসরি জান্নাতের সংযোগ করে দেওয়া হয়। যেখান থেকে জান্নাতের অপরূপ সৌন্দর্য ও নাজ নেয়ামত দেখতে পারেন জান্নাতি ব্যক্তি এবং বেহেস্তের বাতাস, সুগন্ধী বইতে থাকবে কবরের ভেতর। প্রত্যেক মানব সন্তানকে মৃত্যুর সামনাসামনি হতেই হবে, ‘তুমি বল, অবশ্যই সে মৃত্যু যার কাছ থেকে তোমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছো একদিন তোমাদের তাঁর সামনাসামনি হতেই হবে, তারপর তোমাদের সেই মহান সত্তা আল্লাহর দরবারে হাজির করা হবে, যিনি মানুষের দেখা ও অদেখা যাবতীয় কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন, অতপর তিনি সেদিন তোমাদের সবাইকে বলে দিবেন তোমরা দুনিয়ার জীবনে কে কি করছিলে’সূরা জুমুয়াহ০৮। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর প্রথম স্ত্রী হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রাঃ) এর দেহ মোবারক কবরে শায়িত করার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কবরের পাশে বসে রইলেন। তিনি হযরত আবু বক্কর (রাঃ)কে বললেন, হে আবু বক্কর যতক্ষণ আমার খাদিজা কবরের ৩টি প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারবে, ততক্ষণ আমি এখানে বসে থাকবো এবং কবরের উপর থেকে সেই উত্তর আমি দিয়ে দিব, তুমি চলে যাও, আমি এখানেই রইলাম’। আর এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন আরশে আজিম থেকে মহান আল্লাহতায়ালা। সাথে সাথে হযরত জিবরাইল (আঃ) রাসূল (সাঃ)কে বললেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, খাদিজা (রাঃ) যদি কবরের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন, তাহলে আল্লাহতায়ালা নিজেই আরশে আজিম থেকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিবেন, সুবাহানাল্লাহ। মৃত্যু পরবর্তী জীবন অনন্ত, অসীম। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘প্রতিটি জীবকে মরণের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, আমি তোমাদের মন্দ ও ভালো উভয় অবস্থার মধ্যে ফেলেই পরীক্ষা করি, অতঃপর তোমাদের তো আমার কাছেই ফিরিয়ে আনা হবে’সূরা আম্বিয়া৩৫। মৃত্যুর ক্ষণটি অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ, ‘যখন কোন মানুষের প্রাণ তাঁর কন্ঠনালীতে এসে পৌঁছে যায় তখন তোমরা সেখানে অসহায়ের মতন তাকিয়ে থাকো, এই সময় তো বরং তোমাদের চাইতে আমিই সেই মুমূর্ষু ব্যক্তির সবচাইতে বেশি কাছে থাকি। তোমরা এর কিছুই দেখতে পাওনা’সূরা ওয়াক্বিয়া৮৩৮৫। কবরে মুমিনদের যে ৪ টি প্রশ্ন করা হবে। ১। তোমার রব কে? ২। তোমার দ্বীন কি? ৩। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কে দেখিয়ে বলা হবে উনাকে চিন কিনা? ঐ ব্যক্তি যদি মুমিন হয় তাহলে আরেকটি অতিরিক্ত প্রশ্ন করা হবে। তা হল: তুমি যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছতা কোথা থেকে শিখলে? মুমিন ব্যক্তি বলবেনআল্লাহর কিতাব থেকে। মুশরিক ও কাফের ব্যক্তি এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সেই দিনটিকে ভয় কর, যেদিন তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অতঃপর সেদিন প্রত্যেকটি মানুষকে তার কামাইর ফলাফল দিয়ে দেওয়া হবে, তাদের উপর কোন রকমের জুলুম করা হবে না’। আল্লাহতায়ালা কারো উপর অবিচার করেন না। দুনিয়ার জিন্দেগীতে যে যতটুকু ভালো কাজ করেছে, তার পাওনা সে অবশ্যই পাবে। আর আল্লাহতায়ালা ঘোষিত নিষিদ্ধ কাজ করলে তার শাস্তিও অনুরূপভাবে ভোগ করতে হবে। অতএব মৃত্যুর আগেই মৃত্যুর প্রস্তুতি নেওয়া প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর আবশ্যকীয় কর্তব্য। সেই কঠিন কেয়ামতের দিনে কেউ কারো সাহায্যে আসবে না, ‘তোমরা সেই দিনটিকে ভয় কর, যেদিন একজন আরেকজনের কোন কাজে আসবে না, একজনের কাছ থেকে আরেকজনের কোন সুপারিশও গ্রহণ করা হবে না, কারো কাছে কোন মুক্তিপণ নেওয়া হবে না, না তাদের সেদিন কোন সাহায্য করা হবে’সূরা বাকারা৪৮। মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করতে বলা হয়েছে যা জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে উৎসাহী করে।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, সুস্বাস্থ্যের দিনগুলোতে রোগ ব্যাধির জন্য প্রস্তুতি নাও এবং জীবদ্দশায় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর। মৃত্যু এমন এক অমোঘ সত্য যা থেকে আবহমানকাল থেকেই বাঁচতে পারেনি কেউ এবং আগামী কেয়ামত পর্যন্তও বাঁচতে পারবে না। মৃত্যু পরবর্তী কেয়ামতের মাঠে অতি আপনজনও তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াবে, ‘অতঃপর যখন বিকট একটি আওয়াজ আসবে, সেদিন মানুষ তার নিজ ভাইয়ের কাছ থেকে পালাতে থাকবে, তার নিজের মায়ের কাছ থেকে, নিজের বাপের কাছ থেকে, তার সহধর্মিণী থেকে, তার ছেলেমেয়েদের থেকেও’সূরাআবাসা৪২৪৬। সেই কঠিন দিনে দুনিয়ার সমস্ত কিছুর বিনিময়েও মুক্তি পাওয়া যাবে না, ‘তারা দুনিয়ার সমস্ত কিছুর বিনিময় দিয়েও মুক্তি পেতে চাইলে সেই বিনিময় গ্রহণ করা হবে না’সূরা আনআম৭০। দুনিয়ার জীবনে আমরা অর্থের পেছনে ছুটছি আর ছুটছি আর এই ছোটা যেন শেষ হয় না, অথচ তা একদিন বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে আর সেটিই আল্লাহতায়ালা বলছেন এভাবেই, ‘অধিক সম্পদ লাভের পারষ্পরিক প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে গাফেল করে রেখেছে, এমনি করে ধীরে ধীরে তোমরা কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে’সূরা আত তাকাসুর২। জাহান্নামে যাওয়ার জন্য ৪টি জিনিসই যথেষ্ট, জাহান্নামীদের উদ্দেশ্যে জান্নাতিরা জিজ্ঞেস করবে, ‘তোমাদের আজ কিসে এই আযাবে উপনীত করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজীদের দলে শামিল ছিলাম না, অভাবী ব্যক্তিদের আমরা খাবার দিতাম না, যারা অন্যায় অমূলক আলোচনায় উদ্যত হত আমরা তাদের সাথে যোগ দিতাম, আমরা আখেরাতকেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম’সূরা আল মোদ্দাসের৪২৪৬। পরিশেষে, জীবনের চেয়ে আখেরাতের জীবনকেই আমাদের প্রাধান্য দিতে হবেনইলে বড়ই দুঃখ আমাদের কপালে জোটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, ‘কিন্তু তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই আখেরাতের চাইতে প্রাধান্য দিয়ে থাক অথচ আখেরাতের জীবনই হচ্ছে উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী’ সূরা আল আ’লা১৬১৭।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের নারীরা সক্ষম, বুঝতে হবে নিজের শক্তিটা কোথায়
পরবর্তী নিবন্ধস্কাউট পাঠাগার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা