মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা পিতা যখন সঙ্গীতগুরু

বিশ্বজিৎ বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

উপমহাদেশের প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ মনোরঞ্জন বড়ুয়া একটি নাম, একটি ইনস্টিটিউশন। সেই অর্থে জীবদ্দশায় তিনি তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু, মর্যাদাটুকু দেখে যেতে পারেননি। এটি আমাদের জন্য অর্থাৎ আমরা যারা কিনা সংস্কৃতি চর্চা কিংবা সাধনার সাথে জড়িত তাদের জন্য খুবই হতাশাব্যঞ্জক এবং লজ্জাজনক। কারণ আমরা প্রায়শই বলতে শুনি যে দেশে গুনের কদর হয় না সে দেশে গুনী জন্ম নেয় না। আমার মনে হয় কথাটা এখন সেকেলে। অথচ বাবা ভারতবর্ষের বিভিন্ন সঙ্গীত সম্মেলন যেমন- মধ্য কলিকাতা সঙ্গীত সম্মেলন, যদুভট্ট সঙ্গীত সম্মেলন, ডোবার লেন সঙ্গীত সম্মেলন এবং কাশ্মীর সঙ্গীত সম্মেলনে ওস্তাদ বঢ়ে গোলাম আলী খাঁ, ওস্তাদ আমীর খাঁ, পণ্ডীত ভীম সেন যোশী, কিশোরী আমেনকর, পণ্ডিত ভীষ্মদেব চ্যাটার্জি প্রমুখ সঙ্গীত গুনীদের সাথে একই মঞ্চে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ভারতের খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ কেরামত উল্লাহ খাঁ ছিলেন বাবার সতীর্থ। ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাবা একটা আদর্শ এবং নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে পথ চলতে; যা থেকে কেউ কোনদিন তাঁকে কোনভাবেই বিচ্যুৎ করতে পারেনি। তিনি ছিলেন সঙ্গীত সম্রাট মিয়া তানসেনের কন্যাবংশীয় ওস্তাদ দবীর খাঁ (ডি.মিউজ) পদ্মভূষণ সাহেব এর বাংলাদেশের একমাত্র শীষ্য। গুরুর কাছে তিনি দীর্ঘ ১৯ বৎসর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উচ্চতর তালিম গ্রহণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাবা নিজের জীবনকে পরিচালিত করতে দেখেছি। খুব ভোরে উঠতেন ঘুম থেকে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ সেরে প্রাতঃরাশ করার আগেই বসে পড়তেন রেওয়াজে।
আমাদের রেওয়াজের একটি নির্ধারিত ধরণ রয়েছে। যা অন্য কোন সঙ্গীত গুরুর আছে কিনা সন্দেহ। প্রথমে উদারা সপ্তকে এক ঘন্টা ন্যাশ সাধনা, তারপর আস্তে আস্তে মুদারা এবং তারা সপ্তকে যেতেন। এভাবে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সকালে বাবার রেওয়াজ চলতো। আমাদের ঘরানা ছিল সেনী এবং কিরানীর মিশ্রন। রেওয়াজ সেরেই উনি প্রাতঃরাশ সারতেন। আমি পাশের রুম থেকে বাবার রেওয়াজের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করতাম এবং নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করতাম। বাবা প্রথমে আমাকে তালিম অর্থাৎ সঙ্গীত শিক্ষা দিতে আগ্রহী
ছিলেন না। কারণ ঊনার ধারণা ছিল এই দেশে সঙ্গীতের কোন মূল্য নেই, এটা অসুরের দেশ। কথাটা নেহাৎ মূল্যহীন ছিল না, যা পরবর্তীতে জীবনে বুঝতে এবং জানতে পেরেছি। এরই পরেও আমার আগ্রহ দেখে বাবা সঙ্গীতের প্রাথমিক তালিম অর্থাৎ সুর সাধন, পাল্টা পরবর্তীতে পণ্ডিত ভাতখন্ডেজী প্রবর্তিত ১০ ঠাট একের পর এক শেখাতে শুরু করলেন। পাশে আমার মা দাঁড়িয়ে থাকতেন। কারণ সঙ্গীত শিখতে গিয়ে কতই না চড়-তাপ্পড় খেয়েছি তার ইয়েত্তা নেই; বকুনিতো ছিলই। তারপরেও বাবার কাছ থেকে যতটুকু নিতে পেরেছি তা আমার জীবনের পথের পাথেয় বলে আমি মনে করি। কারণ বাবার ছিলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ওপর প্রচন্ড জ্ঞানভান্ডার, গভীরতা। যা অনেকে বুঝতে পেরেও হীনমন্যতায় স্বীকার করেননি। আবার অনেকে বুঝতে পারেননি বাবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর দখল কী পরিমাণ ছিল। তিনি অনেক ছাত্র-ছাত্রী তৈরী করে গেছেন; তবে কেউই কখনো খুব একটা খোঁজ খবর নিতে দেখিনা। এটি এক ধরণের অকৃতজ্ঞতা এবং বেইমানী।
বাবা বলতেন আমরা তালিম নেওয়ার জন্য গুরুর পেছনে পেছনে ঘুরতাম। আর এখন গুরুকে শিক্ষার্থীদের পেছনে দৌঁড়াতে হয়। কাজেই সহজ ধারনা সঙ্গীতের মূল্যায়ন আর অবস্থান এখন কোন পর্যায়ে। অনেক সঙ্গীত শিক্ষককে বলতে শুনি প্রকৃত শিল্পী হতে নাকি পান, সিগারেট, মদ ইত্যাদি সেবন করতে হয়। তা না হলে ওস্তাদী-ওস্তাদী ভাব আসে না। বাবা বলতেন গলা ঠিক রাখতে গেলে সঠিক নিয়মে ধারাবাহিক রেওয়াজই যথেষ্ট, এখানে অন্য কোন উপাদানের প্রয়োজন পড়ে না। আসলে তাই ঠিক এবং প্রকৃত সত্য। সব কিছুকে ছাপিয়ে বাবা তার নিজস্বতা নিয়েই জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। জীবনে কোন দিন সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী ছাড়া অন্য কোন পোষাক তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। এতকিছু নিয়মনীতি এবং সাধনার মধ্য থেকে তাঁর জীবদ্দশায় প্রাপ্য সম্মানটুকু যখন নিয়ে যেতে পারেন না, দেখে যেতে পারেননি তখন স্বাভাবিক নিয়মে দুঃখ হয়, কষ্ট লাগে। সমাজের জন্য, সংষ্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে যার অবদান কোন ভাবেই যেখানে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে অবহেলা করাটা কত যে ক্ষোভের, কত যে গর্হিত কাজ ছিল তা প্রকাশ করার মত ভাষা আমার জানা নেই।
আমি উনার বড় ছেলে হিসেবে ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকের জন্য সংষ্কৃতি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বাবার জীবন বৃত্তান্ত ফাইল আকারে জমা দিয়ে এসেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আসলে একুশে পদক কে পায়, কারা পায়, কীভাবে পায়, কী জন্য পায়, কেন পায় তা জানতে আমার কয়েক বছর সময় লেগে যায়। যখন জানতে পারি তখন বাবা পরোপারে চলে যান। সংষ্কৃতি মন্ত্রণালয়ে নাকি একটা অদৃশ্য চক্র রয়েছে, যারা নির্ধারণ করেন দেন কে যোগ্য, কাকে সম্মাননা দেওয়া যায়। তাতে অলিখিত নির্দেশনা রয়েছে- তার রাজনৈতিক পরিচিতি থাকতে হবে, না হয় মামা চাচা থাকতে হবে আর না হয় অর্থ ব্যয় করতে হবে। তবেই জুটবে কাঙ্ক্ষিত সেই সম্মান বা পুরষ্কার। অর্থাৎ প্রকৃত গুনির কদর কোনকালে কিংবা কোনভাবেই জুটবে না এটাই অপ্রিয় সত্য। ১৯৬৮ সালের শেষ ভাগে তিনি অবিভক্ত ভারত থেকে মাতৃভূমিতে চলে আসেন। ১৯৭০ সাল থেকেই বাবা চট্টগ্রাম রেডিওতে তালিকাভুক্ত হয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকেন এবং অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত সঙ্গীত পরিবেশন করেই গেছেন। পুরষ্কার স্বরূপ (রেডিও’র) বর্তমান বেতারের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক জনাব আবুল হোসেন একটা ৩,০০০/- (তিন হাজার) টাকার চেক নিয়ে বাসায় দেখতে আসেন। যা ছিল অনাকাঙ্খিত এবং অনভিপ্রেত। আমি পরবর্তীতে সেই চেক অঞ্চলিক পরিচালক বরাবরে অফিস গিয়ে ফেরৎ দিয়ে আসি। এই হচ্ছে আমাদের দেশে গুনীর প্রতি সম্মান এবং মর্যাদা। এ থেকে সহজেই অনুমেয় এই দেশের প্রকৃত সঙ্গীত গুণী কোন দিনও তৈরী হবে না। সঙ্গীত চিরতরের জন্য হারিয়ে যাবে। এমনিতেই বর্তমানে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অবস্থান একেবারই তলানিতে। এমনভাবে খাদে পড়ে গেছে তা থেকে টেনে তোলা প্রায়ই অসম্ভব। তারপরেও আমরা যারা কিছুটা তালিম আয়ত্ত করে সঙ্গীত পরিবেশন করার চেষ্টা করছি ভবিষ্যতে তারও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে আমার অভিমত। যাক আজ ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ খ্রীঃ বাবার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি অতল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সম্মান জানাই। উনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, আমাদের জন্য আশীর্বাদ করুন, সংষ্কৃতি সেবী এবং শিক্ষার্থী যারা ভবিষ্যত সংষ্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তাদের প্রতি বিশেষ সুভাশীষ তাঁর কাছে প্রার্থনা করছি।
লেখক : সাংবাদিক ও সঙ্গীতশিল্পী

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেগম রোকেয়া : নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ
পরবর্তী নিবন্ধনারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া