অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন অনন্যসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। কি সাংবাদিকতা, কি সমাজসেবা, কি শিক্ষা, কি রাজনীতি, কি সংস্কৃতি, প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। প্রতিটি বিষয়ে তিনি ছিলেন সমান ওয়াকিবহাল। সব বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা ছিল বলে যে কোনো সভা–সমাবেশে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করতে সক্ষম হতেন। তিনি যখন বক্তৃতা দিতেন, তখন সুন্দর সরল ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ শুনে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হতেন। বেশি সময় ধরে বক্তৃতা দিতেন না। স্বল্পকথায় কংক্রিট বক্তব্য উপস্থাপন করতেন। ঋজু, দিকনির্দেশনামূলক ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যদানে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। একই দিনে অনেকগুলো সভায় বক্তৃতা দিতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু কোনো জায়গায় বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি থাকতো না। সকল বক্তৃতা হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র প্রকৃতির।
সাংবাদিকতায় আগমন বিষয়ে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকই আমাকে নিয়ে এলেন সাংবাদিকতায়। এমন একজন মহাত্মার পরশ নিয়ে আমি বড় হয়েছি, যিনি ছিলেন নিখাদ খাঁটি মানুষ। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এসে তাঁর ইচ্ছে হলো চট্টগ্রাম থেকে একটি দৈনিক পত্রিকা বের করবেন। একদিন আমাকে ডেকে নিয়ে বসালেন। বললেন, খালেদ আমার দীর্ঘ দিনের সখ ও ইচ্ছা, চট্টগ্রাম থেকে একটি দৈনিক প্রকাশ করার। তুমি যদি আমার সাথে ওয়াদা করো, পত্রিকার সাথে থাকবে, তাহলে আমি উদ্যোগ গ্রহণ করবো। আমি তাঁর কাছে ওয়াদা করলাম। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে সত্যি সত্যি দৈনিক আজাদী নামে একটি পত্রিকার অনুমোদন নিয়ে এলেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর যাত্রার সাথে তিনি আমাকে সাংবাদিক বানালেন। তাঁর মৃত্যুর পর আমি হলাম সম্পাদক। এই হলো আমার সাংবাদিকতা জীবনের পদযাত্রা।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন আদর্শবান সাংবাদিক। সাংবাদিকতার নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত হন নি। পরমতসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সংবাদ–প্রতিবেদন আর সম্পাদকীয় মন্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার দুরূহ কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করেছেন অধ্যাপক খালেদ। সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে তিনি যেমন সত্যনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেছেন, তেমনি সম্পাদকীয় নীতিতে দেশের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্কের নীতির সম্মানজনক সঙ্গতি রক্ষা করেছেন। সংবাদ প্রতিবেদনে যার যা প্রাপ্য কিংবা পাওয়া উচিত, তা তিনি অকৃপণভাবে দিয়ে গেছেন এবং এর পাশাপাশি সম্পাদকীয় মন্তব্যে বিষয় কিংবা ঘটনা বিশেষের মূল্যায়নপূর্বক নির্দেশনা দিয়েছেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বহু ঝক্কি–ঝামেলা ও ধাক্কা সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন। ঝুুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতা পেশায় তিনি ছিলেন সফল সৈনিক। নীতির ব্যাপারে ও সত্যানুসন্ধানে তিনি ছিলেন আপসহীন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কোনো নীতি বিবর্জিত কর্মে তিনি লিপ্ত হন নি। সত্য ও ন্যায়ের দৃঢ় সমর্থক হিসেবে কাজ করেছেন। আদর্শ ও পেশার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রসৈনিকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
অভিজ্ঞ কোনো সাংবাদিক না থাকা সত্ত্বেও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক যেমন কোহিনূর পত্রিকা ও প্রেসে সফল হন, তেমনি দৈনিক আজাদীকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। সম্পাদক হিসেবে তিনি অতুলনীয়। পত্রিকার জগৎকে নিজের জগৎ হিসেবে রূপান্তর করেন তিনি। সম্পাদকীয় লেখা, সংবাদ লেখা থেকে শুরু করে প্রুফ দেখার কাজও করতেন তিনি। সবকিছুর তদারকি তাঁর হাতে। নিয়মিত বসতেন নিউজ টেবিল। এপিপি, এএফপি, রয়টার্স, বাসস পরিবেশিত ইংরেজি নিউজ থেকে অনুবাদ করতেন। কখনো কখনো প্রেস রিলিজ থেকে সংবাদ তৈরি করতেন।
কখনো কখনো অন্যের তৈরি নিউজের ওপর চোখ বুলাতেন। ছোটোখাটো ত্রুটি থাকলে তা শুদ্ধ করে দিতেন আর বেশি কিছু বিচ্যুতি ঘটলে তিনি নিউজটি নিজে করে নবীনদের সামনে তুলে ধরে বলতেন; পড়ুন। মিলিয়ে দেখুন। অধ্যাপক খালেদ শুধু সম্পাদক হিসেবে নন, শুধু সাংবাদিক হিসেবেও নন, সামাজিক ব্যক্তিসত্তা হিসেবে অনেক অবদান রেখেছেন। ১৯৬২ থেকে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় একচল্লিশ বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক খালেদ। বাংলাদেশে এতো দীর্ঘদিন কেউ একটা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন না। মনে হয় না আগামীতেও তাঁর এ কৃতিত্ব কেউ স্পর্শ করতে পারবে!
অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন একজন নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ মানুষ। এরকম মানুষ সমাজে বিরল। সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান করেও তিনি পায়ে দলে গেছেন সব রকমের লোভ–লালসার ভিত্তি, উপেক্ষা করেছেন যাবতীয় হাতছানি। অনেক সুযোগ তাঁর কাছে অবারিত ছিলো। কিন্তু সেই বিত্ত সম্পদ–আরাম–আয়েশের লোভ সামলে নিয়ে সমাজের অনন্য বটবৃক্ষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সব মানুষ এ ধরনের লোভ সংবরণ করতে পারেন না, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের মতো প্রবল মানসিক শক্তির অধিকারী মানুষরাই কেবল পারেন।
একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ হয়েও আপাদমস্তক তিনি ছিলেন অসামপ্রদায়িক। সব শ্রেণির, সব ধর্মের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল মমত্ববোধ। উন্নত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ বলতে যা বোঝায়– অধ্যাপক খালেদ তাই। আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছি।