মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে এসেছি

কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা।।যেভাবে বাঁচলেন কায়রোস জাহাজের বাংলাদেশি চারজনসহ ২৫ নাবিক ।। এদের একজনের বাড়ি সন্দ্বীপ ।। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এটি দ্বিতীয় ঘটনা

হাসান আকবর | সোমবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৪:৩৮ পূর্বাহ্ণ

ঘটনার ১৬ ঘণ্টা পরও স্বাভাবিক হননি বাংলাদেশি নাবিক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুল ইসলাম। হোয়াটসঅ্যাপে গতকাল দুপুরে কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল কাঁপছিলেন তিনি। ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় দফায় দফায় ঢোক গিলেন। তুরস্কের ইজমিত শহরের একটি হোটেলে অবস্থান করছেন নাবিকেরা। প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয় বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার। ফোনে তিনি বলেন, ঘটনার কথা কী বলব ভাই? মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে এসেছি।

এভাবেই শুরু করেন তুরস্কের কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের ড্রোন হামলার শিকার ‘এমটি কায়রোস’ নামে জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশের নরসিংদীর নাবিক মোহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম। তিনি আজাদীকে বলেন, জাহাজে আমরা ৪ জন বাংলাদেশিসহ ২৫ জন নাবিক ছিলাম। বাকিদের মধ্যে চীনের ১৯ জন, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার একজন করে দুজন। ভাগ্যক্রমে আমরা সবাই বেঁচে ফিরেছি। আমরা সবাই সুস্থ আছি।

মাহফুজুল ছাড়াও ওই জাহাজে থাকা অপর তিন বাংলাদেশি নাবিক হলেন কুষ্টিয়ার আল আমিন, ঢাকার ধামরাইয়ের হাবিবুর রহমান ও সন্দ্বীপের আজগর হোসাইন। তারা চারজনসহ মোট ২৫ নাবিক তুরস্কের ইজমিত শহরের একটি হোটেলে অবস্থান করছেন। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

মাহফুজুল বলেন, আমাদের জাহাজটি চীনের একটি অয়েল ট্যাংকার। জাহাজটি বড়, দৈর্ঘ প্রায় ২৭৫ মিটার। জাহাজটি স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। তেল পরিবহনের জন্য খালি ট্যাংকার নিয়ে মিসরের পোর্ট সুয়েজ থেকে রাশিয়ায় নভোরোসিস্ক বন্দরের দিকে যাচ্ছিলাম। তুরস্কের বিখ্যাত বসফরাস প্রণালী পার হয়ে কৃষ্ণসাগরে ছিলাম। স্থানীয় সময় বিকাল পৌনে ৫টা নাগাদ আমাদের ট্যাংকারের দিকে নৌযানের মতো তিনটি ড্রোন দ্রুতগতিতে ছুটে আসছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা প্রথম হামলার শিকার হই। একটি ড্রোন এসে জাহাজের প্রপেলার (পাখা) গুঁড়িয়ে দেয়। ড্রোন হামলায় বিকট শব্দ হয়, জাহাজটি প্রচণ্ড কেঁপে ওঠে। জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলেন, জাহাজের চীনা ক্যাপ্টেন সবাইকে দ্রুত ব্রিজে সমবেত হওয়ার ঘোষণা দেন। আমি কেবিনে ছিলাম। বের হয়ে উপরে ওঠার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখনই দ্বিতীয় ড্রোন আঘাত হানে। এতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। মুহূর্তেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করে। জাহাজটি চালানোর জন্য ওখানে এক হাজার টনের বেশি জ্বালানি তেল ছিল। বিস্ফোরণের পর ওই জ্বালানিতে আগুন ধরে যায় এবং তা জাহাজের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। জাহাজের যে লাইফ বোট তাও আগুনে পুড়ে যায়। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল লাইফ জ্যাকেট পরে সাগরে ঝাঁপ দেওয়া। কিন্তু তারও উপায় ছিল না। ওখানে তখন মাইনাস টেম্পারেচার। ঠান্ডায় জমে কেউ বাঁচতে পারব না। তাছাড়া চারদিকে আগুন জ্বলছিল। আমরা ঝাঁপ দিলেও আগুনে পড়তাম। বাঁচার সব পথ রুদ্ধ দেখে আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম।

ক্যাপ্টেন এসওএস দিয়ে তুরস্কের কোস্ট গার্ডকে ঘটনা জানান। তুরস্কের কোস্ট গার্ড জানায়, জাহাজটি থেকে তারা যে দূরত্বে রয়েছে সেখানে পৌঁছাতে তাদের এক ঘণ্টা লাগবে। চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখার মাঝে যখন প্রতিটি সেকেন্ড মৃত্যুর প্রহর গুণছিলাম, তখন এক ঘণ্টা অনেক বেশি সময়। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কাছে থাকা একটি বাণিজ্যিক জাহাজ থেকে লাইফবোট নামিয়ে আমাদের উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসে। তবে জাহাজের চারদিকে তখন তেল এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ায় তারা আমাদের উদ্ধার করতে পারেনি। লাইফবোটটি যখন আমাদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয় তখন আমরা জীবিত উদ্ধার হওয়ার আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম।

কায়রোস জাহাজের ক্যাডেট কুষ্টিয়ার আল আমিন হোয়াটসঅ্যাপে বলেন, ক্যাপ্টেন আমাদেরকে দ্রুত লাইফবোট নামানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা চারজন বোট নামানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আগুন ছড়িয়ে পড়ায় বোট নামানো সম্ভব হয়নি। আমাদের লাইফবোটেও আগুন ধরে যায়, বিস্ফোরিত হয়। চারদিকে তেল ছড়িয়ে পড়ে। পানিতেও আগুন জ্বলছিল। আসলে ওই সময়টা কীভাবে ছিলাম সেটা বলে বোঝানো অসম্ভব। আমরা কী পরিমাণ অসহায় বোধ করছিলাম তাও কাউকে বোঝাতে পারব না।

জাহাজটির নাবিক ধামরাইয়ের হাবিবুর রহমান বলেন, এই অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো নয়। আমরা শুধু একজন আরেকজনের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিচ্ছিলাম। মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে ফিরেছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

সন্দ্বীপের আজগর হোসাইন জাহাজটিতে নাবিক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি বলেন, আমি ওই সময় ডেকে অবস্থান করছিলাম। দেখলাম, তিনটি স্পিডবোট আমাদের অনুসরণ করছে। আমি জলদস্যু টাইপের কিছু হবে ভেবে সাথে সাথে বিষয়টি ক্যাপ্টেনকে জানাই। কিন্তু হামলার পর বুঝতে পারি, ওগুলো স্পিডবোট নয়, নৌ ড্রোন ছিল। হামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কী বলব ভাই? এখনো গা শিউরে উঠছে। এত আগুনের মাঝে মৃত্যুর প্রহর গোনা কাকে বলে তা বলে বোঝানো অসম্ভব। আমরা লাইফ জ্যাকেট পরেছি, কিন্তু সাগরে ঝাঁপ দিতে পারছি না। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। তুরস্কের কোস্ট গার্ড উদ্ধার না করলে আমাদের বেঁচে ফেরা হতো না।

ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুল আলম বলেন, তুরস্কের কোস্ট গার্ড আমাদের কাছে আসতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এ দুই ঘণ্টায় আমরা প্রতিটি সেকেন্ড হিসেব করেছি। কোস্ট গার্ড পুড়ে যাওয়া জাহাজ থেকে একে একে আমাদের ২৫ জন নাবিককে উদ্ধার করে। তারা আমাদেরকে নিকটস্থ ইজমিত শহরে নিয়ে যায়। সেখানে একটি হাসপাতালে আমাদের প্রাথমিক পরীক্ষা ও চিকিৎসা শেষে কোস্ট গার্ডের নিয়ন্ত্রণে একটি হোটেলে অবস্থান করছি। এখানকার পোর্ট অথরিটি আমাদেরকে ডেকেছেন। ওখানে একটি মিটিংয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশি চার নাবিকই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছেন জানিয়ে মাহফুজুল ইসলাম বলেন, কথা হয়েছে, তবে কবে যে এই ট্রমা থেকে বেরুতে পারব বুঝতে পারছি না। ক্যাপ্টেন আমাদের জাহাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছেন। ওই জাহাজটি আর চালানোর উপযোগী নেই। তিনি বলেন, আমাদের সবার পাসপোর্ট সাথে আছে। তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে এখনো যোগাযোগ হয়নি। একটু ধাতস্থ হয়ে যোগাযোগ করব।

রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধে এটি বাংলাদেশি নাবিকদের দ্বিতীয়বার ঝুঁকিতে পড়ার ঘটনা। ২০২২ সালের ২ মার্চ ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এমভি বাংলার সমৃদ্ধি নামে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পরিত্যক্ত হয়। ওই জাহাজে নিহত হয়েছিলেন বাংলাদেশি নাবিক প্রকৌশলী হাদিসুর রহমান।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন গতকাল আজাদীকে জানান, নাবিকদের সবাই সুস্থ আছেন, তারা হোটেলে অবস্থান করছেন। তুরস্কের কোস্ট গার্ডের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকতে পারে। ওগুলো সম্পন্ন করে তারা দেশে ফিরবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধছয় লেনের দাবিতে কক্সবাজার মহাসড়কে অবরোধ
পরবর্তী নিবন্ধবাধা কাটল, নতুন ট্যারিফ আদায়ের উদ্যোগ বন্দর কর্তৃপক্ষের