আইসের বিশাল নেটওয়ার্ক এখন বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইয়াবার চেয়েও কয়েকগুণ ক্ষতিকর হলো আইস। মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন কৌশলে ঢুকছে মাদকটি। আইস চোরাচালানের সব পথ এখনই বন্ধ করতে না পারলে ইয়াবার মতো এটিও ছড়িয়ে পড়বে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। গত ৮ মে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘একশ বিশ কোটি টাকার আইস জব্দ’ শীর্ষক সংবাদে জানা যায়, কঙবাজারের উখিয়ায় অভিযান চালিয়ে উচ্চ মাত্রার মাদক ক্রিস্টাল মেথ আইসের একটি বড় চালান জব্দ করেছেন র্যাব –১৫ সদস্যরা। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৪ জন মাদক চোরাকারবারীকে। তাদের মধ্যে পুলিশের সাবেক এক সদস্যও রয়েছে। গত রোববার দুপুর ১২টায় কঙবাজার ব্যাটালিয়ন র্যাব–১৫ এর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে ২৪ কেজি ২০০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইস। যার আনুমানিক মূল্য একশ’ ২০ কোটি টাকা। মাদক উদ্ধার অভিযানে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হল উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী এলাকার মোহাম্মদ ইমরান ওরফে ইরান মাঝি (৩৩), তার ভাই মোহাম্মদ রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল (২৬), উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের মো. আলাউদ্দিন (৩৫) এবং টেকনাফের জয়নাল আবেদীন ওরফে কালাবদা (৩৭)। র্যাবের দাবি, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মোহাম্মদ ইমরান ওরফে ইরান মাঝি সীমান্তে মাদক চোরাকারবার চক্রের অন্যতম হোতা। তার বিরুদ্ধে মাদকসহ ৭টির বেশি মামলা রয়েছে। মো. আলাউদ্দিন সাবেক পুলিশ সদস্য। তিনি ইরান মাঝির অন্যতম সহযোগী এবং সম্প্রতি বিজিবির অভিযানে ২১ কেজি আইস উদ্ধার ঘটনায় আটক গডফাদার বুজুরুজ মিয়ার নিকটাত্মীয়। ২০১৭ সালে মাদক বহন ও পাচারের অভিযোগে পুলিশের চাকরি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। খন্দকার আল মঈন দাবি করেন, এই অভিযানে উদ্ধার করা ২৪ কেজি ২০০ গ্রামের চালানটি দেশে এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ক্রিস্টাল মেথ আইসের সর্ববৃহৎ মাদকের চালান। তিনি বলেন, ইরান মাঝির নেতৃত্বে উখিয়া সীমান্তে মাদক চোরাকারবারের চক্র সক্রিয় রয়েছে। চক্রটি সীমান্তের দুর্গম পথ দিয়ে মিয়ানমার থেকে মাদকের চালান আনার পর গভীর পাহাড়ের ভেতরের আস্তানা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তা মজুত করে রাখে। সুবিধাজনক সময়ে বিভিন্ন কৌশলে কক্সবাজার ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদক পাচার করে। নির্মাণাধীন একটি ভবনে কৌশলে প্যাকেটজাত করে লুকিয়ে রাখা অবস্থায় এগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। কক্সবাজার ও ঢাকায় আটককৃতদের শক্ত সহযোগী রয়েছে। মাদক বিক্রির অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়ে থাকে বলে ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, মিয়ানমার থেকে আগে নাফ নদী হয়ে সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে আইস ঢুকলেও এখন আরও কয়েকটি নতুন রুট হয়েছে। ইয়াবার পরবর্তীতে দেশটি আইসের দিকে ঝুঁকছে। শুধু যে তারা টেকনাফ দিয়ে আমাদের দেশে পাঠাচ্ছে তা নয়, কারণ আমাদের দেশে যে চাহিদা আছে এ জন্য বিকল্প রুট তারা করেছে। তাদের (মিয়ানমার) সঙ্গে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লিংক আছে। মিজোরাম থেকে ত্রিপুরা আসছে ল্যান্ড বর্ডার হয়ে সহজে বাংলাদেশে ঢুকছে।
তাঁরা আরও বলেন, আইসের প্রধান কাঁচামাল তৈরি হয় ভারত ও চীনে। মিয়ানমারের কাছে এসব কাঁচামাল বিক্রিতে আরও সতর্ক হলে দেশটিতে আইসের উৎপাদন অনেকটাই কমে যাবে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এখনই এ মাদকটির চোরাচালান রোধ করতে না পারলে ইয়াবার মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিষয়টি নিয়ে শূন্য সহনশীলতার কথা বলেছেন, সেটি অনুসরণ করে যদি দায়িত্বপ্রাপ্তরা কাজ করতেন তা হলে অনেকটাই সুফল পাওয়া যেত।
আজাদীতে প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইস লবণের মতো দানাদারজাতীয় মাদক। দেখতে কখনো চিনির মতো, কখনো মিছরির মতো। আইস উচ্চমাত্রার মাদক, যা সেবনের পর মানবদেহে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আইসের দাম ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষতি বা প্রভাবও বেশি। এটি সেবনে মস্তিষ্ক বিকৃতিতে মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়া অনিদ্রা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, হৃদরোগকে বেগবান করে। এই মাদক সয়লাব হলে ইয়াবার চেয়ে বেশি বিপর্যয়ের মুখে পড়বে তরুণ সমাজ। স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়ছে না আইস। আইস গ্রহণ করলে এর নেশা সহজে ছাড়তে পারে না মাদকসেবীরা। অনেকে অভিযোগ করেন, সব ধরনের মাদকের চালান জব্দকালে বহনকারীই আটক হয়ে থাকে। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলে ওরা কারাগারে যায়। কিন্তু মূল মাদক ব্যবসায়ীরা আড়ালে থাকায় নতুন পরিবহনকারী সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মাদক আসা বন্ধ না হয়ে উলটো বাড়ছে। তাই মাদকের বিস্তার রোধ করতে চাইলে মূল মাদক কারবারীকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা খুবই জরুরি। তাছাড়া, সামাজিক ও পারিবারিক ভাবেই মাদক ব্যবসায়ীদের বয়কট করতে হবে।