মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখনই নিরাশ হওয়া যাবে না

নতুন কারিকুলাম নিয়ে বললেন শিক্ষামন্ত্রী ।। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক উন্নয়নে জোর ।। কথা বললেন অনুমোদনহীন মাদ্রাসার বিষয়েও

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখনই নিরাশ হওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেন, আমাদের মানসিকতা হয়ে গেছে পরীক্ষা আসলেই পড়তে পাঠাব। সেই প্রক্রিয়া আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে ছিল। কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক অর্থে যোগ্যতা, দক্ষতা দিতে পারছিলাম না। জিপিএ৫ পেলেও দক্ষতায় অনেক গ্যাপ থেকে যায়। তাই পরীক্ষা একসাথে না করে বছরব্যাপী মূল্যায়নে আসি। মূল্যায়ন পদ্ধতিটা এ মাসে শুরু হলো। ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা জানতে পারবে বা শিক্ষার্থী কতটা এগিয়েছে বা পিছিয়ে আছে। তাই আমাদের নিরাশ হলে চলবে না। গতকাল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে জনপ্রতিনিধিদের করণীয়’ বিষয়ে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দেন। একইসঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধিদের মনিটরিং করার আহ্বান জানান। এ সময় বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপস্থিতিও কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের জন্য জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ করেন। সভায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম চৌধুরী, মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু, আবদুচ ছালাম ও এম এ মোতালেব, রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহেছানুল হায়দর চৌধুরী বাবুল, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা বক্তব্য রাখেন।

নতুন কারিকুলাম বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নতুন কারিকুলামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একটা বয়স পর্যন্ত সবাই সবকিছুর ন্যূনতম শিক্ষা পাবে। নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন পদ্ধতিটা এ বছর থেকে মাত্র শুরু হয়েছে। এখনও প্রথম মাস শেষ হয়নি। কিন্তু শুরু হওয়ার আগেই আলোচনাসমালোচনা, অপপ্রচার। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে কিন্তু অনেক বিষয়ে অপ্রপচার হয়। যেমন পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির কথা বলে ব্যাপক অপপ্রচার শুরু হয়েছিল। অনুরূপভাবে নতুন কারিকুলামের ক্ষেত্রে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আজ তো মাত্র ২১ তারিখ, ১ তারিখ থেকে নতুন কারিকুলাম শুরু হয়েছে। অনেকগুলো শ্রেণিতে এবার প্রথম। এখনো ক্লাসগুলো সঠিকভাবে শুরু হয়নি। এরপরও অপপ্রচার চলছে। অনলাইনে অনেকগুলো ভিডিও জোড়াতালি করে কন্টেন্ট বানানো হয়েছে। হ্যাঁ, কিছু কিছু পাঠ্যবইয়ে কিছু সমস্যা আছে, সেটা আমাদের নজরে এসেছে। আমরা সংশোধন করছি।

শিক্ষক সংকট প্রসঙ্গে নওফেল বলেন, এনটিআরসিএর মাধ্যমে অলরেডি ৩৯ হাজার শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। সরকারি স্কুলে পিএসসির মাধ্যমে ১৬শ শিক্ষক আসছে। কিন্তু ৩৯ হাজার শিক্ষক আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিসংখ্যান। অর্থাৎ ৩৯ হাজার শিক্ষক অনুপস্থিত ছিল। চট্টগ্রামে দেয়া হয়েছে ২ হাজার ২০০ জন। তার মানে এই পদগুলো শূন্য ছিল।

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষএনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, একেকবারে ৩০ হাজার ও ৪০ হাজার শিক্ষক দিই আমরা। তার মানে ৩০৪০ হাজার শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিল। এতগুলো শিক্ষক যেখানে অনুপস্থিত সেখানে কীভাবে মানসম্পন্ন শিক্ষা আমরা দিতে পারব? বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানতে পারলাম, অনেক ক্ষেত্রে অবসরে যারা গেছেন তাদের দিয়ে কাজ চালানো হয়।

তিনি বলেন, অনেক সরকারি স্কুলেও শিক্ষক সংকট আছে। চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে ১০১২ বছর ধরে থাকা শিক্ষকদের আমরা উপজেলায় পাঠাতে পারছি না। সেক্ষেত্রে আমাদের উপজেলা নেতৃবৃন্দ, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সদস্যদের বলব, আমাদের সঙ্গে কমিউনিকেশন একটু বাড়িয়ে ডিমান্ডটা শক্তিশালীভাবে দিতে হবে।

নওফেল বলেন, আমার আসনেই সবচেয়ে বেশি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে যদি শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে থাকেন এবং উপজেলাতে খালি থাকে সেটা কিন্তু আমার ব্যর্থতা। উপজেলা নেতৃবৃন্দকে বলব, আপনারা আমার কাছে নিয়মিত চাইবেন। আপনার ওখানে দীর্ঘদিন বসে আছে, তাকে ট্রান্সফার করছেন না কেন? আমরা শিক্ষক পাচ্ছি না কেন? আমাকেও জবাবদিহিতার মধ্যে আনবেন। আসলে এককভাবে কিছু করা সম্ভব না, সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কিন্ডারগার্টেনের মতো হওয়া মাদ্রাসাগুলোর বেশিরভাগই হয় কওমি মাদ্রাসা। কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের অনুরোধ করব, আপনাদের মনিটরিংটা করতে হবে। কারণ কওমি মাদ্রাসাগুলোর বেশিরভাগ অনিবন্ধিত। সেগুলোর রেজিস্ট্রেশন নেই। আমাদের হাটহাজারীতে আমাদের যে বড় মাদরাসা আছে, সেখান থেকে নূরানি পর্যায়ের একটা অনুমোদন নিয়ে এসে সেগুলো খুলে দেয়া হয়। গতকাল হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলেছি। উনাদের কাছে ডাটাবেজ চেয়েছি, বাংলাদেশে উনারা কতগুলো নূরানি মাদ্রাসা অনুমোদন দিয়েছেন। অনেকগুলোর অনুমোদনও নেই, কিন্তু চালিয়ে নিচ্ছে, চলছে। ভিক্ষাবৃত্তির কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে কিছু শিশুকে। এক্ষেত্রে আপনাদের (জনপ্রতিনিধি) কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।

তিনি বলেন, সরকারি সিলেবাস দ্বারা পরিচালিত আলিয়া মাদ্রাসা আছে। সেখানে কিন্তু ন্যাশনাল কারিকুলাম পড়ানো হচ্ছে। আলিয়া মাদ্রাসায় কিন্তু বিদ্যালয়ের মতো তিনটা বিশেষায়িত সাবজেক্ট আছে। সুতরাং আলিয়া মাদরাসা থাকতে কেন আমরা যততত্র ফোরকানিয়া বা নূরানি মাদ্রাসা খুলব? কেউ যদি পড়তে চায় সে আলিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে পড়বে। সুতরাং নিজ নিজ পর্যায়ে অনুৎসাহিত করতে হবে।

নওফেল বলেন, হেফজ পড়ানোর জন্য অনেকগুলো মাদ্রাসার নাম দেয়া হয়। কিন্তু সেগুলো বৈকালিক বিদ্যালয় হতে পারে। মানে রেগুলার স্কুলিংয়ের বাইরে যদি তারা করে তাহলে সমস্যা নেই। বিশেষায়িত ধর্মীয় শিক্ষাও যদি কেউ দিতে চান, তাও রেগুলোর স্কুলিংয়ের বাইরে পড়ানো হয়।

মন্ত্রী বলেন, এবতেদায়ি মাদরাসা কিংবা কিন্ডারগার্টেন স্কুল, এগুলো খোলার আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এটা ওরা নেয় না। সামাজিক বাস্তবতায় একটা বিদ্যালয় চালু হয়ে যাওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। খুলে দেওয়ার পরে কাগজপত্র যদি নাও থাকে, তবুও একটা সোশ্যাল প্রেসার তৈরি হয় যে, এই বাচ্চাগুলো কোথায় যাবে। এটা অমানবিক বলা হয়ে থাকে সামাজিকভাবে। যেসব অভিভাবক এসব প্রতিষ্ঠানের সুবিধা নিচ্ছেন, সেটা এবতেদায়ি হোক আর কিন্ডারগার্টেন হোক, তাদের কারণে আমরা আর বন্ধ করতে পারি না।

কিন্ডারগার্টেনের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধির মনিটরিংয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খোলার শুরুতেই যখন উদ্যোক্তারা আপনাদের কাছে যাবেন, তখনই আপনারা তাদের নিরুৎসাহিত করবেন। আপনি মাদ্রাসা খুলছেন, কিন্ডারগার্টেন খুলছেন, আপনি কে? আপনার ডিটেইলসটা কী? আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড কী? জানতে চাইবেন অবশ্যই। অভিভাবকদের বলতে হবে, আশেপাশে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে তো আসন খালি আছে। আপনি সেখানে আপনার সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছেন না কেন? অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি রাতারাতি ফ্লোর ভাড়া করে শুরু করে দেওয়া হলো। এভাবে তো চলতে পারে না।

জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিয়ে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে কাজ করে, পলিসি মেকিংয়ে। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে আমরা অনেক তথ্য পাই। তারা সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু যারা জনপ্রতিনিধি তারা সরাসরি সার্বক্ষণিক সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে অনেক রেসপন্সিভ এবং তাদের সঙ্গে কাজ করে। তাই জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য অনেক জরুরি।

সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। কারণ শিক্ষার্থীদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশে সংস্কৃতি চর্চা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমার মনে হয় বর্তমানে সংস্কৃতি চর্চার অভাবই দেশের অনেক সমস্যার মূলে। তাই সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সংস্কৃতি চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।

কারিগরি শিক্ষায় জোর দিয়ে তিনি বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ জরুরি এবং এ খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রামে সরকারি স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধির দাবি জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএইচএসসিতে বৃত্তি পেলেন ৯২৫ জন
পরবর্তী নিবন্ধপ্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার দায়িত্বে ফিরলেন জয়