চট্টগ্রাম কাস্টমসে ইট–বালু কিংবা মূল্যহীন বস্তু আমদানির মতো ঘটনা ঘটেছে অসংখ্যবার। এ সব পণ্য আমদানির মাধ্যমে মূলত আমদানিকারকরা অর্থপাচার করতেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তবে ধরা পড়া সেই সব চালানের আমদানিকারকরা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলতেন, তাদের সাথে রপ্তানিকারকরা প্রতারণা করে এসব মূল্যহীন বস্তু কিংবা ইট–বালু পাঠিয়েছেন। গত রোববার সাড়ে পাঁচ বছর আগে চীন থেকে আমদানি করা একটি চালান নিলামে তোলার জন্য ইনভেন্ট্রি (গণনা) করতে গিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তারা দুই কন্টেনার ইট এবং একটি মাত্র ৩৯টি হুইল চেয়ার দেখতে পান। ঢাকার তোপখানা রোডের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লোটাস সার্জিক্যাল তিন কন্টেনার পণ্য আমদানি করে। কন্টেনারভর্তি মূল্যহীন ইট এনে আমদানিকারক অর্থপাচার করেছে বলে জানিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে আমদানিকারককে শোক’জ (কারণ দর্শানো) করা হবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরপরে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান কাস্টমস কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, আমদানি–রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই অর্থপাচার হয়ে আসছে। আমদানিতে মূল্যহীন বস্তু এনে অর্থাপাচার হচ্ছে। আবার রপ্তানিতে অতিরিক্ত পণ্য রপ্তানি করে এবং রপ্তানিকৃত পণ্যের অর্থ আটকে রেখে অর্থপাচারও করতেন এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী।
জানা গেছে, গত ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল কুমিল্লা বুড়িচংয়ের ময়নামতি বাজারের সাকুরা স্টিল লিমিটেড সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২০ কন্টেনারে ৫৩৬ টন স্ক্র্যাপ আমদানি ঘোষণায় নিয়ে আসে ১১৫ টন কনক্রিট ব্লক। পণ্য আমদানির জন্য রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের দিলকুশা শাখায় একটি আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়। এলসিতে পণ্যের মূল্য ধরা হয় ১ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৪ মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। দুবাইয়ের জাবেল আলি বন্দর থেকে এমভি স্মাইলি লেডি জাহাজ যোগে এসব কন্টেনার আনা হয়।
অপরদিকে ২০২০ সালে নারায়নগঞ্জের ফতুল্লা বিসিক শিল্প এলাকার আমদানিকারক সোয়ারা ফ্যাশন চীন থেকে দুই চালানে ৪৬ টন পলয়েস্টার সুতা আমদানি ঘোষণা দেয়। ঘোষণা অনুযায়ী এসব পণ্য আমদানি করতে প্রতিষ্ঠানটি এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ৫০ হাজার ডলারের ঋণপত্র খোলে। কিন্তু আমদানিকারক ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য না এনে দুই কন্টেনার বস্তা ভর্তি বালু নিয়ে আসে। সুতার বদলে বালু এনে আমদানিকারক মানি লন্ডারিং করেছেন জানায় কাস্টমস কর্মকর্তারা।
অপরদিকে গত ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর বন্ড সুবিধায় সুতার বদলে বালু ও মাটির বস্তা নিয়ে আসে গাজীপুরের এনজেড এক্সেসরিজ লিমিটেড। আমদানিকারক সেই সময় এক কন্টেনারে ২৫ টন সুতা আমদানির ঘোষণা দেয়।
চালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল নগরীর আগ্রাবাদের সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান কালকিনি কমার্শিয়াল এজেন্সিজ লিমিটেড। এছাড়া গত ২০১৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম বন্দরে চীন থেকে আসা ২০ ফুট লম্বা এক কন্টেনারে ১৯ হাজার ৬৫৬ কেজি ‘ডাবল এ ফোর’ কাগজের বদলে পাওয়া যায় বালু ও মাটি। ঢাকার বনানীর প্রগ্রেস ইমপেক্স লিমিটেড নামের এক আমদানিকারকের নামে চালানটি চট্টগ্রাম বন্দরে আসে।
অন্যদিকে কাস্টমসের দুর্বল নজরদারির কারণে পণ্য রপ্তানির চালানেও হচ্ছে অর্থপাচার। অনেক সময় পণ্য জাহাজীকরণের আগে সঠিক নিয়ম কায়িক পরীক্ষা করা হয় না। এ ছাড়া একশ্রেণীর অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদেরকে ম্যানেজ করে ঘোষণা অতিরিক্ত পণ্য রপ্তানি করার অভিযোগ রয়েছে। গত ২০২২ সালের ২২ মার্চ ঢাকার গুলশানের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইনফিনিটি সার্ভিস সলিউশনের বিরুদ্ধে নন–বন্ডেড বা লোকাল তৈরি পোশাক রপ্তানির নামে ২২ লাখ টাকা পাচারের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নগরীর আগ্রাবাদ এলাকার সিএন্ডএফ এজেন্ট ডায়নামিক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এছাক ডিপোতে তৈরি পোশাকের চালান জাহাজীকরণের জন্য কন্টেনারে লোড করে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পণ্য চালানে ৩৮ হাজার ৩১১ পিস তৈরি পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলে। তবে ৩৮ হাজার ৩১১ পিস পোশাকের বদলে তারা ৮৩ হাজার ৩৫১ পিস রপ্তানির চেষ্টা করেন। কায়িক পরীক্ষা শেষে ৮৩ হাজার ৩৫১ পিস তৈরি পোশাকের মূল্য দাঁড়ায় ৪০ লাখ ৮৮ হাজার ২৪১ টাকা। ফলে ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৪৮৬ টাকা পাচারের চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এছাড়া একই বছরের ১৯ জানুয়ারি ঢাকার উত্তরার আরএম সোর্সিং বাংলাদেশ নামের একটি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান চারটি পোশাক রপ্তানির চালানের আড়ালে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৮ টাকা অর্থপাচারের চেষ্টা করেছে বলে জানান চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখার কর্মকর্তারা। ফিলিপাইনে চালানগুলো রপ্তানির জন্য একটি বেসরকারি কন্টেনার ডিপোতে কন্টেনারে লোড করা হয়। এ সব চালানে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ছিল নগরীর সদরঘাটের বেঙ্গল প্রগ্রেসিভ এন্টারপ্রাইজ। আরএম সোর্সিং চারটি বিল অব এঙপোর্টের বিপরীতে আইএফআইসি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি করে। রপ্তানিকারকের ঘোষিত ২৪ হাজার ৩৪৪ পিসের (প্রতি চালানে ৬ হাজার ৮৬ পিস) বিপরীতে মোট ২৯ হাজার ৯৪৪ ইউরো (প্রতি পিসের ঘোষিত মূল্য ১ দশমিক ২৩ ইউরো) বা ২৯ লাখ ৬০ হাজার ২৪৮ টাকা পাওয়া যেত। তবে সঠিক ঘোষণা থাকলে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৯২ লাখ ২৭ হাজার ৯৫২ টাকা পাওয়া যেত। অর্থাৎ রপ্তানিকারক এ চারটি চালানে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮৮ টাকা পাচারের চেষ্টা করেছে বলে জানায় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ–কমিশনার মো. সাইদুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, গত সাড়ে ৫ বছর আগে ঢাকার আমদানিকারক লোটাস সার্জিক্যাল হুইল চেয়ার আমদানির ঘোষণা দিয়ে দুই কন্টেনারে ইট এবং একটি কন্টেনারে মাত্র ৩৯টি হুইল চেয়ার আমদানি করে। আমদানিকারক চালানটি খালাস না নেয়ায় দীর্ঘ সময় কন্টেনার তিনটি চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে ছিল। তখন সম্প্রতি অখালাসকৃত পণ্য নিলামে তোলার জন্য ইনভেন্ট্রি করার সময় বিষয়টি ধরা পড়ে। মূল্যহীন বস্তু এনে এখানে পরিস্কার অর্থপাচার করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। এখন আমদানিকারককে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠাবো। তারপর তার বিরুদ্ধে কাস্টমস আইনে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।