মূল্যবোধ মানুষকে তার কর্মপদ্ধতির ভালো মন্দ অনুধাবন করতে সহায়তা করে। সততা, ন্যায় পরায়ণতা, শিষ্টাচার, শৃঙ্খলা, সৌজন্য, সহনশীলতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলি হচ্ছে মূল্যবোধের উপাদান।
মূল্যবোধ ধারনাটি অস্পষ্ট হলেও তা মানুষের একটি আত্মিক সম্পদ। মূল্যবোধ কথাটির অর্থ মূল্যবান, মর্যাদাপূর্ণ। মানুষ যা সম্বন্ধে উৎসুক, যা সে চায়, যা সে হতে চায়, যা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করে, যার প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা আছে ও বিশ্বাস আছে তাকে মূল্যবোধ বলে। মূল্যবোধ হচ্ছে এমন একটি মানদণ্ড যার মাধ্যমে ভালোমন্দ কাজের বিচার করা হয়। মূল্যবোধ মানুষকে সঠিক পথে চালনা করে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আমরা পরিবার, সমাজ, বন্ধু–বান্ধব, বিদ্যালয় থেকে মূল্যবোধ অর্জন করি। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে মূল্যবোধ এর ভূমিকা রয়েছে।
ভালো বই পড়ে আমরা জ্ঞান অর্জন করি আর এই জ্ঞান হল মূল্যবোধ। জীবনকে আরামদায়ক করে তোলার প্রচেষ্টাও হল মূল্যবোধ। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার আগ্রহও এক ধরনের মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধ আমাদের শিল্প সৃষ্টিতে আগ্রহী করে তোলে। বিভিন্ন ধরনের শিল্প যেমন– ছবি আঁকা, গান গাওয়া, লেখালেখির চর্চা করা, আবৃত্তি ইত্যাদি। আবার জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেকটি কাজকর্মকে সঠিক ও সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করা এবং তা হতে তৃপ্তি পাওয়ার জন্য ধর্মীয় পাদপীঠে গমন করাও হল মূল্যবোধ। মূল্যবোধ আছেই বলে আমরা ভালো মন্দের বিচার করতে পারি। মূল্যবোধ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূল্যবোধ একটি মানবিক গুণ, এটি মানবিক গুণাবলির সব থেকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ। এই গুণের কারণেই আমরা মানুষ হিসেবে ভালো চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকি।
মূল্যবোধ এর সৃষ্টি হয়ে থাকে কিছু আচরণের ওপর ভিত্তি করে। আর এই মূল্যবোধ তৈরি হয়ে থাকে আমাদের সমাজ–দেশের প্রচলিত নিয়ম এর ওপর নির্ভর করে, দেশ–সমাজ ভেদে মূল্যবোধ এর পার্থক্য হয়ে থাকে।
মূল্যবোধ আমাদেরকে ভালোকে ভালো বলতে আর খারাপকে খারাপ বলতে শেখায়। মূল্যবোধ শিক্ষা আমাদের প্রতিদিনকার দিনের সাথে তাল মিলিয়ে পথ চলতে শেখায় ও কখন কোথায় কীভাবে নিজেকে তুলে ধরতে হয় তা শেখায়। একটি আদর্শ পরিবারই মূল্যবোধের সঠিক শিক্ষা দিতে পারে। পরিবার থেকেই আমরা মূল্যবোধের শিক্ষা পেয়ে থাকি। মূল্যবোধ মানে সম্মান এবং বিশ্বাস মানে ভরসা আর যে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা, আদর্শ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে তাই হল মূল্যবোধ শিক্ষা। মূল্যবোধ হল সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি।
মূল্যবোধ এর দুইটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো
১. সৎ, ২. উপকারী।
কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক–
আপনি হয়তো সকলের সাথে কথা বলতে ভালোবাসেন কিন্তু সকলে আপনাকে বাচাল ভাবে। আপনি পরিচিত জনকে টাকা ধার দিতে পছন্দ করেন না, সম্পর্ক অবনতি হলে, কিন্তু আপনাকে সে স্বার্থপর ভাবে।
এবার বলি, আপনি ঠিক কাজই করেন এবং করবেনও। কারণ এইগুলো আপনার নৈতিক মূল্যবোধ। সবাই এইগুলো বুঝবে না, জোর করে বোঝাতে যাবেনও না। কারণ দিনের শেষে যে আপনাকে ভালোবাসে, সম্মান করে সেই জানে নৈতিক মূল্যবোধ কাকে বলে। ব্যক্তিগত মূল্যবোধ বলতে বোঝায় আপনার শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংস্কার, শুভবুদ্ধি, চিন্তা, বিচারবোধ। এই সবকিছু কতটা হ্যাঁ বাচক। সেখানেই আপনার মূল্যবোধ। ব্যবসায়িক মূল্যবোধ বলতে এমন একটি মানদণ্ডকে বোঝায় যার ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়িক রীতিনীতি, চিন্তা–চেতনা, ধ্যানধারণা তথ্য ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে পরিচালিত হয়।
ধর্মীয় মূল্যবোধ বলতে বোঝায় মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস, তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ এবং নৈতিক মূল্য সম্পর্কে। এটি মানুষের সমাজিক বন্ধন এবং তার নৈতিক নীতিমালা নির্ধারণ করে। এটি পরিবার, সমপ্রদায় এবং সামাজিক সম্পর্কে সামগ্রিক মান নির্ধারণ করে।
সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের সামাজিক সম্পর্ক, সহযোগিতা, সামাজিক ন্যায়, বাংলা সংস্কৃতি এবং মানবাধিকারের বিষয়ে মূল্য স্থাপন করে। এটি একটি সামাজিক ব্যবস্থার রচনা, পরিবর্তন এবং সমাজের উন্নতির দিকে নির্দেশ করে।
মানবিক মূল্যবোধ হচ্ছে শৃঙ্খল ও ন্যায় সমাজ গঠনের প্রথম শর্ত। মানবিক মূল্যবোধ বলতে কতগুলো মনোভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিশ্বাসকে বুঝায়। যে চিন্তা–ভাবনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষের মানবিক আচরণ, ব্যবহার ও কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে তাই মানবিক মূল্যবোধ। ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও শিষ্টাচার মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বড়দের সম্মান করা, তাদের সেবা করা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা প্রভৃতি মানবিক মূল্যবোধের উদাহরণ। মানবিক মূল্যবোধ ব্যক্তির মানসিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। আর এভাবে ব্যক্তিসত্তা বিকাশ করে এটি সুশাসনের পথকে প্রশস্ত করে।
সাধারণত কোনো সমাজের অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের কাছ থেকে প্রাপ্ত কল্যাণকর ও কাঙ্ক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ ও স্থায়ী মূল্যবোধ বলতে সাধারণ ভাষায় কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজে প্রচলিত অথবা সমাজ কর্তৃক চালিত কাঙ্ক্ষিত জীবন ব্যবস্থাকে বুঝায়। এর প্রভাব শুধু বিশ্বাস বা আদর্শকে মূল্যবোধ বলা হয়। মূল্যবোধকে একটি প্রত্যয় হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এই প্রত্যয়ের উপাদান হচ্ছে নীতি, মান ও বিশ্বাস। এ সব উপাদান স্পষ্ট করে দেয় ব্যক্তি, সমাজ বা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, ভালো–মন্দ, দোষ–গুণ, ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা বিচার করে এবং নৈতিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে কাজের দিক নির্দেশনা।
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ও লেখক স্টুয়ার্ট সি ডড –এর কথায় ‘মূল্যবোধ হলো সেই সকল রীতি–নীতির সমষ্টি যা ব্যক্তি সমাজের কাছ থেকে পেতে চায় এবং যা সমাজ ব্যক্তির কাছ থেকে লাভ করে।’ অর্থাৎ মূল্যবোধ হচ্ছে সমাজে প্রচলিত কিছু ধারণা, বিশ্বাস ও রীতিনীতির সমষ্টি যা দ্বারা সমাজে বসবাসরত জনসাধারণ প্রভাবিত হন বা নিয়ন্ত্রিত হন। আবার জনগণের আচার, ব্যবহার ও রীতি–নীতিও সমাজে প্রচলন ঘটে। সমাজে প্রচলনের ফলে সেটি আবার সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে বিকাশ লাভ করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মূল্যবোধ বা সামাজিক মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার ফলে ব্যক্তি আত্মবিকাশ ও আত্ম উন্নয়নের সুযোগ পায়। সামাজিক মূল্যবোধগুলোর ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে একটি জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। সামাজিক মূল্যবোধ নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের প্রেরণা যোগায়।
পরিশেষে বলি মূল্যবাধ আমাদের জীবনের মহা সম্পদ। এই সম্পদ নিজগুণে অর্জন করে নিতে হবে এবং যথাযথভাবে প্রতিপালন করতে হবে নিজের আচরণের মাধ্যমে।
আমরা আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংস্কার, শুভবুদ্ধি, চিন্তা, বিচারবোধ এই সবকিছু কতটা হ্যাঁ বাচক করতে পেরেছি সেখানেই আমাদের মূল্যবোধ সংরক্ষিত থাকবে এবং সেটাই দেশের কল্যাণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
লেখক: কবি–গল্পকার।