মুস্তফা নঈমের ‘স্মৃতি বিস্মৃতির কানুনগোপাড়া’

অরূপ কুমার বড়ুয়া | সোমবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

মুস্তফা নঈম। আমার কলেজ জীবনের সহপাঠী রাঙ্গুনিয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক মুস্তফা শামীম আল জুবায়ের ছোট ভাই এবং আমার কলেজ পড়াকালীন স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলাইমান স্যারের দ্বিতীয় সন্তান। আবাল্য সংস্কৃতি ও সংগঠন প্রিয় সুলেখক, বিশিষ্ট সাংবাদিক। বর্তমানে জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠের চট্টগ্রাম বুরো প্রধান। আমার অঞ্চল কানুনগোপাড়ায় কৈশোর ও যুব সময়ের নানান কথা নিয়ে রচিত ‘স্মৃতি বিস্মিতি কানুনগোপাড়া’ বইটি তাঁরই লেখা।

লেখকের অনেক স্মৃতি আমাকেও নষ্টালজিক করে তুলেছে। কারণ আমি ঐ এলাকার সন্তান হিসেবে লেখকের মত ছোট বয়স থেকে এই কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে আমার মামা প্রধান শিক্ষক সুনীল কান্তি বড়ুয়া জিএস আমার কাকা প্রধান শিক্ষক অচিন্ত্য কুমার বড়ুয়া এজিএস নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছিলেন। কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ক্রীড়া, কলেজের নাটক বিভিন্ন ছাত্রাবাসের বার্ষিক নাটক, কলেজের রজত জয়ন্তী, কলেজে পড়ার সময় নানা প্রকার সাহিত্য সংস্কৃতি ও ক্রীড়ানুষ্ঠান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুখস্মৃতি আন্দোলিত করেছে। কলেজে প্রতি শুক্রবার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রদত্ত প্রথম রঙিন টেলিভিশনে নতুন কুঁড়ির অনুষ্ঠান দেখার সময় দেওয়া ছিল। তাছাড়া সপ্তাহের একদিন একটি ক্লাসে উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক সাহিত্য আলোচনার কবিতা পাঠের ব্যবস্থা ছিল। বার্ষিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলত সাপ্তাহব্যাপী। এইসব কর্মসূচিতে বিভিন্ন বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ জানানো হত। পল্লীকবি জসীম উদদীন এবং সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের উজ্জ্বল উপস্থিতির কথা আমার মনে এখনো রেখাপাত করে আছে। সুলিখিত এই গ্রন্থে কানুনগোপাড়া তথা বোয়ালখালীর আমার অজানা তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে যা আমাকে ঋদ্ধ করেছে। হাওলা পরগনা থেকে লেখকের দেখা তৎকালীন নানা ইতিহাস ঐতিহ্য হাট বাজার মেলা মাজার মন্দির খুঁটিনাটি ইতিহাসের নানা উপাদান সংগ্রহ করে বিভিন্ন পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে।

লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব অল্প বয়সী হলেও তার স্মৃতিকথাগুলো আমাকে চমৎকৃত করেছে। মুক্তিযুদ্ধে কানুনগোপাড়া তথা বোয়ালখালী, তার নানার বাড়ি সীতাকুণ্ড এবং শহরের কিছুদিনের ঘটনা প্রবাহ নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন। এই কলেজে স্বনামধন্য অধ্যক্ষ শহীদ শান্তিময় খাস্তগীর এবং মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই কলেজ পরিদর্শন করিয়েছিলেন আমার দেখা সুদর্শন ব্যক্তিত্ব শহীদ অধ্যাপক দীলিপ চৌধুরীর কথা, যুদ্ধের শুরুতে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কানুনগোপাড়া আগমন ঐতিহাসিক তথ্য সমৃদ্ধ করেছে এই অংশকে।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার এই কানুনগোপাড়ার ও আশেপাশের মানুষের অবদান, মাস্টারদা সূর্য সেনের সারথিদের নামগুলো তুলে এনে এলাকায় ঐ সময়ের মানুষের চিন্তা চেতনা এবং কর্মকাণ্ডের অনেক বিবরণ আমাকে আপ্লূত করেছে।

স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট মায়ের নামে বালিকা বিদ্যালয়, ভাইয়ের নামে উচ্চ বিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠাতা রত্নগর্ভ পরিবারের এগারটি রত্নের অবাক করা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাঁদের কর্মজীবন সম্পর্কে লেখা অংশটিও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। উনাদের এক ভাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন এবং কলেজে আগমনের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে।

সারা বোয়ালখালীর প্রতিটি গ্রামের সফল মানুষদের কষ্টলব্ধ বিশাল এক তালিকা (যা আমারও অনেক জানা ছিল না) দেখে অবাক হয়েছি যে কত যোগাযোগে এবং কীভাবে সম্ভব হলো। কারণ লেখকের শিশু কৈশোর এবং যৌবনের কিছু সময় এই এলাকায় থাকা হলেও তার পৈত্রিক নিবাস চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া গ্রামে।

বসন্ত উৎসব’ কানুনগোপাড়া ও আশেপাশের গ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক বিশাল ইতিহাসকে লেখক তুলে এনেছেন পরম মমতায়। কীভাবে মহোৎসবের পরিবর্তে সকল ধর্মের উর্ধ্বে উঠে সকল ধর্মের মেলবন্ধনের একমাত্র চাবিকাঠি সংস্কৃতিকে নিয়ে ভাবনার প্রশংসা এই বসন্ত উৎসব যাদের চিন্তার ফসল তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বিশেষ করে প্রবীর চৌধুরী বন বাবু যার ব্রেইন চাইল্ড বসন্ত উৎসব তাঁকে স্যালুট জানাই।

লেখকের লেখা তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এই কানুনগোপাড়ার একজন কৃতী পুরুষ যিনি লেখকের শিক্ষক এবং এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁকে নিয়ে রচিত একটি গল্প এই বইয়ের সাথে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।

লেখক একজন সাংবাদিক হওয়াতে চমৎকার সাবলীল ভাষায় প্রায় দুইশত পৃষ্ঠার বই পাঠে আনন্দ লাভ করলাম অনেক অজানা তথ্য জানা গেল তৎজন্য কানুনগোপাড়া তথা বোয়ালখালীবাসীর পক্ষ থেকে লেখককে ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রচ্ছদ মোটামুটি ভালো লেগেছে। অক্ষর বিন্যাস ভালো তবে কিছু শব্দের ত্রুটি বিদ্যনাম। ইতিহাস ও শিক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা কানুনগোপাড়া সম্পর্কে যাদের জানার ইচ্ছে, কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং এলাকায় পাঠক পড়ে জানার এবং আনন্দ পাবার অনেক উপকরণ এই বইয়ে রয়েছে।

সবশেষ যাকে ধন্যবাদ কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় যিনি নিজ উদ্যোগে বই প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়ে লেখককে উৎসাহিত করেছেন তিনি আমাদের প্রিয় গবেষক ড. শামসুদ্দিন শিশির। বইয়ের শেষ মলাটে গ্রন্থ প্রসঙ্গ লিখে যিনি বইয়ের মান বৃদ্ধি করেছেন, তিনি হলেন বিশিষ্ট গবেষক কথাশিল্পী ড. আজাদ বুলবুল। তাঁকেও আন্তরিক শুভেচ্ছা।

লেখক : কবি, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধহে কবি
পরবর্তী নিবন্ধভয়াল ২৯ এপ্রিল স্মরণে